ছুটির ঘণ্টা

ফাহমিদা খানম:

মা, তুমি জানো না আমার শতো কথারা আজও তোমায় খুঁজে বেড়ায়। এতো বয়স হলো, আজও কিছু হলেই তোমাকে খুঁজি, ভুলেই যাই প্রকৃতির নিয়মে তুমি চলে গেছো। কখনও সেই স্নেহের হাত আমায় আর বুকে টেনে নেবে না।
তোমার অভিমানী মেয়েটা জীবনের পদে পদে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে অনেক বদলেছে নিজকে। কষ্ট পেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিমানের দৃষ্টি দেয়, কোন অভিযোগ আর অভিমান করে না। জেনেই গেছে দুনিয়াদারী মেয়েদের কথা ভাবে না।

সবাই বলে সময় নাকি সব ক্ষত ভুলিয়ে দেয়, কই মা, আমার ক্ষতরা যে আজও সেইরকম তাজা! তোমার দস্যিপনা করা মেয়েটা মোটা অভিমানের চশমা পরে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। মা-বাবা ছাড়া দুনিয়াশুদ্ধ কার এতো দায় পড়েছে তোমার মেয়ের চোখের পানির মূল্য দিতে! মাঝে-মধ্যে খুব রাগ হয় তোমাদের উপরে, কেন আমাকে স্বার্থপর দুনিয়ায় অন্য সবার মতো করে গড়ে তোলনি?

কেন বলেছিলে আমি মানুষ! আমি তো বুঝেছি আমি মানুষ নই, তুচ্ছ মেয়েমানুষ! সত্য মুখের উপরে বলার পর সবাইর দ্বৈত চেহারা দেখেছি আমি। ন্যায্য কথা বলে বেয়াদব খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছি। আড়ালে শুনেছি মা -বাবা মেয়েকে সঠিক শিক্ষাই নাকি দিতে পারেনি। কেন মেয়েমানুষ হয়ে সবার মুখের উপরে কথা বলবে! হায়, যে মেয়েকে সদা সত্যবতী বানাতে চেয়েছো, তাতে সবাই বিরক্ত আর বিব্রত হয়েছে।

লেখক: ফাহমিদা খানম

যেসব মেয়ে দ্বৈত মুখোশ পরে থাকে, সবাই তাদেরকে সাধুবাদ দেয়। আমি এসব পারি না মা। মুখোশ পরতে আমি পারিনি। আমি চারপাশের মুখোশ পরা মানুষ দেখতে দেখতে বড় ক্লান্ত মা। আমার চোখের ভাষা, মনের ভাষা বোঝার দায় পড়েনি দুনিয়ার। যে মেয়েকে তুমি প্রীতিলতা, মার্গারেট থ্যাচার আর ইন্দিরা গান্ধীর গল্প শোনাতে, বাস্তবতায় এসে সেই মেয়ে হেরে গেছে। আচ্ছা তুমিও কি আমার মতো নিজের ধারালো সত্ত্বা ভোঁতা করে জীবনের সাথে আপোষ করেই ছিলে? নিজের মেয়েকে সেই জায়গায় দেখতে চাওনি বলেই কি সলতে উসকেছিলে, নাকি সবই আমার মনের ভুল?

তোমার মেয়ে চলার পথে বারবার শুনেছে –

“মেয়েমানুষ এমনতরো কেন! ”

–ছকের বাইরে দেখে সবাই তেড়েমেড়ে এসেছে। বেমানান হবার ভয়ে কতো জীবন!

—নারী জীবন নিজেকে শামুকের মতো খোলসে পুরে নেয়! আমার আমিকে নিয়ে সবাই শুধু বিব্রত হয়। আমি যা বলার মুখের উপরেই বলি, অন্যায় দেখলে চুপ করে থাকতেই পারি না। সবার কাছে আমি জেদি, কিন্তু বিশ্বাস করো মা, আমার ভিতর আত্মসম্মানবোধ বড় বেশি। এই এতোটা পথ পাড়ি দিয়েও আমি নিজেকে বদলাতে পারিনি, অক্ষমতার দায়ভাগ আমার একার।

আজকাল আমার অনুভুতি অসাড় হয়ে গেছে। বিশ্বাস করবে, সন্তানেরাও পুরানো পৃথিবীর চশমা পরেই আমাকে বিচার করেছে। তারা ভাবে, আমি তাদের বাবার স্ত্রী আর তাদের মা, আমি যে দিব্যি একটা মানুষ —-তারাও ভাবেনি। আমি কি তাহলে ভুলের নৈবেদ্য জুগিয়ে গেলাম, মা? সংকীর্ণতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যে সন্তানেরাও আমাকে বুঝলো না, নাকি ইচ্ছে করেই বুঝতে চায় না? এই বিশাল পৃথিবীতে কতো জীবন অপচয় হয়, কতো দীর্ঘশ্বাস ভেসে বেড়ায় –কেউই জানে না। নিজের সকল আনন্দের মুখে বাঁধ দিয়ে চলাই কি নারীজীবন!

বোকার মতো আশা করেছিলাম কাছের মানুষগুলো আমায় অন্তত বুঝবে! আজ এই মধ্যবয়সে এসে উপলব্ধি করলাম, স্বার্থে আঘাত পড়লে সন্তানরাও দূরে সরে যেতে, আঘাত করতে এক মুহূর্ত দেরি করে না। সবাই যে যার ভাবনাচিন্তা নিয়েই থাকে। মাকে বুঝবার, জানবার এতো সময় নেই কারও। নিজের বিবেকের কাছে আজীবন পরিষ্কার থাকতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ছিঁচকাঁদুনে, ন্যাকাপনা করা মেয়েগুলোই বরং ভালো আছে। সংসার ভোঁতা আর বোকাসোকা মেয়েদের পছন্দ করে, শান দেয়া, ধারালো মেয়েদের খালি বাহবা দিতে পছন্দ করে। এদেরকে সংসারে বেমানান ভাবে। আমি মেরুদণ্ডহীন হতে চাইনি বলেই সবার অভিযোগ আর অনুযোগের ডালা।

“এ কেমনধারা মেয়েমানুষ! কান্না করে না, ব্যঙ্গ -বিদ্রুপ গায়ে মাখে না, আঘাত করলে উল্টো প্রতিবাদী হয়!”

নিজের অজান্তেই সবার চক্ষুশূল হলাম আমি, কেন অন্য আট/দশটা মেয়েদের মতন নই আমি! —কতো যে এসব শুনতে হয়!

আগে আমি ভাবতাম গ্রামের গরীব মেয়েরা কেবল অসহায় থাকে, বাস্তবতা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো, অনেক নারীজীবন প্রজন্মান্তর একই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি কেবল। যেখানে জোরের ভীত নড়বড়ে, সেখানে খুঁটি পোতাই ভুল। নির্বুদ্ধিতার খেসারত টেনে চলাই হয়তো জীবন। চোখের জল আজকাল আর নেই।

মধ্যবয়স খুব খারাপ মা, শরীর, মনের কতো পরিবর্তন যে আসে! সবাই ভেবেই নেয় দিন ফুরিয়েছে —। অনেক ইচ্ছেরা মন চাইলেও আর ডানা মেলার সাহস পায় না। হাজারও চোখ বলে দেয়, বয়স হয়েছে, এখন তুমি বদলাও। আমার চাওয়া সেখানে অবান্তর। ছেলেমেয়েও বিরক্ত হয় মায়ের ইচ্ছেতে, অথচ ওদের ছোটবেলায় নিজেদের আনন্দের মুখে বাঁধ দিয়েছিলাম বড় হলে স্বপ্ন ছোঁবো বলে।

সবাই ধরেই নেয় মধ্যবয়সী নারীদের কোন ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকতে নেই। স্ত্রী আর মা এই ছকবাঁধা জীবনের বা্ঁইরে আবার কীসের চাওয়া? এতোকাল সংসার সামলেছো, এখন দাদী -নানী হয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে। আমার যে মেঘ ছোঁয়া হলো না, পাহাড়, জংগলে ঘোরা হলো না। এতো বয়স হলো, তাও কিশোরীবেলা ভোলা হলো না। সবার কাছে এসব ন্যাকাপনা মনে হয়।

“আরে বাবা বয়স হইছে, এখন দিন-দুনিয়ার কথা চিন্তা না করে মরণের কথা ভাবো”!

সবার মুখে একইরকম কথা শুনতে শুনতে আজকাল স্নায়ুও ক্লান্ত। সারাটা জীবন শুধু অন্যের ইচ্ছের কাছে নতজানু হয়ে থাকা! মেয়েদের মানুষ কে কবে ভেবেছে? ন্যায্য কথা বললেই সমাজ, সংসার উল্টো নারীবাদী খেতাব দিয়েছে। সেটাই সহজ-সাধন কাজ। শো-কেসের পুতুল বউ হয়ে যে থাকে, তাকেই লক্ষ্মী খেতাব দিয়ে দেয়। কোনটা বেশি দামী, নিরাপত্তা না আত্মসম্মানবোধ? এক জীবনে এটাই বুঝে উঠতে পারলাম না আমি। বৃত্তবন্দী হয়ে থাকাই বুঝি ভালো মেয়ের সংজ্ঞা? সত্য মুখের উপরে বললে সবার মুখের উপর থেকে ভালোমানুষীর মুখোশ ভেঙ্গে সগর্বে বেরিয়েই আসে রুঢ় সত্যটা।

নিজেকে বড় অক্ষম মনে হয় মা, সহনশীলতার সবটুকু উজাড় করেও জীবনসংসারে অনেককিছুই আমি মেনেই নিতে পারিনি। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি কেউ টের পায়নি। দিনে দিনে সংসারের বন্ধনে শিকড় ছড়িয়েছে, তবুও পারিনি স্রোতের তালে তাল মিলিয়ে চলতে। আমার চেনা অনেকেই দ্বৈত মুখোশ পরেছে, আমিই পারিনি, আজীবন নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে গিয়ে অবহেলাই জুটেছে কপালে। আমার প্রত্যাশা, আবেগ, চিত্তের ক্ষুধা মেটেনি।

নানীর মুখে শোনা রুপকথার সেই সুঁচকুমার মনে হয় নিজেকে। সারা শরীরে কতোশত কথার আঘাতের সুঁচ বয়ে বেড়াই —–কেউই জানে না। হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো মাঝে-মধ্যে উঁকিঝুঁকি দেয় আমি আর অনাভ্যাসে তাদের মুক্ত আলোয় আনি না। কী জানি সেটাও হয়তো অপরাধজনক। মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মতো হাসিমুখে অভিনয় করেই যাচ্ছি।

একদিন সবকিছুর অবসান হবে, আমার ছুটি হবে। অনেক গল্প আমি জমিয়ে রেখেছি। যে স্বপ্নরা আলোর মুখ দেখেনি, তারা আকাশে উড়াল দেবে। কৃত্রিমতার হাসি ঝুলিয়ে মেকি ভাব দেখাতে হবে না। আমি অপেক্ষায় আছি ছুটির ঘণ্টার, কখন পড়বে সেই ঘণ্টা!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.