শুধু কর্ম দিয়েই দাসত্ব থেকে মুক্তি মেলে নারে বইন

ফারজানা নীলা:

দীর্ঘদিন পর গ্রামে গিয়ে ভীষণ ভাল লাগা এবং অনেক উপলব্ধি নিয়ে ফিরলাম। আমাদের গ্রামটি এখন আর আগের মতো জীর্ণ-শীর্ণ নেই। বেশ উন্নতই হয়েছে। আর্থিক অবস্থা ভাল হয়েছে, পুরুষরা শহরে বা বিদেশ গিয়ে ভালোই আয় করছে। অধিকাংশ মহিলার চোখে মুখে সুখের ঝলকানি। সুখে আছে শান্তিতে আছে। স্বামীর কথা জানতে চেয়ে গালের দু পাশ লাজুক-লাজুক আভাও দেখা যায়। বয়স্করা ছেলের চাকরির কথা বলে বেশ বুক ফুলিয়েই, আর মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারার প্রশান্তিটাও প্রকাশ পায় স্বাচ্ছন্দ্যে।

এখন যদি কেউ বলে এই উন্নতি কোন উন্নতি নয়, এখানে শুধু ছেলেরা স্বাধীনতা পেয়েছে মেয়েরা সেই ঘরের অন্ধকারেই ডুবে আছে। তাহলে কথাগুলো যেমন বড্ড বেমানান তেমনই যদি এদের গিয়ে এসব বুলি আওড়ান, কথাগুলো তাদের মাথার দুই হাত উপর দিয়ে যাবে। তাদের কাছে স্বাধীন-পরাধীন এসব কোনো বিষয়ই না। তাদের কাছে সুখটাই প্রধান। সুন্দর পোশাক পরবে, ভালো খাবে, সন্তানদের স্কুলে দিবে, স্বামীর সোহাগ পাবে, স্বামীই সব চাহিদা মেটাবে। এর নাম সুখ, এর নাম শান্তি। এরা এভাবেই চিন্তা করে, এভাবেই স্বপ্ন দেখে। এর ব্যতিক্রম সেই সমাজে মানায় না। তারা মানবেও না। এখানে নারীবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।

তবে গ্রহণযোগ্য কোথায়? শহরে? নাকি মানুষের মননে? শহুরে নারী স্বাধীন কীভাবে বোঝা যায়? সে চাকরি করে সে শিক্ষিত? এই দিয়ে? না অহরহ অগণিত নারী খুঁজে পাওয়া যায়, যারা আয় করে ঠিকই কিন্তু আশেপাশে বা নিজ পরিবারের গঞ্জনাও সহ্য করে। প্রতিবাদ তারা করতে জানে না, বা চায় না। তারা আবেগী, বা অতিরিক্ত ভালোবাসাকেন্দ্রিক। এরা সব কিছু ত্যাগ করতে রাজি শুধুমাত্র প্রিয় মানুষের খাতিরে, অথবা লোকলজ্জার ভয়ে। এরা অফিসে বসে আয় হয়তো করে, কিন্তু মানসিকভাবে এরা আবদ্ধ। এদের বেলায়ও নারীবাদ খাটে না।

আসলে কোনটা জরুরি? সুখ না স্বাধীনতা? ধরেন স্বাধীনতা পেলেন (যদিও স্বাধীনতার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম), কিন্তু সুখ পেলেন না, তবে জীবনটা কেমন কাটবে? অথবা সেই গ্রামের মেয়েটি, যার কাছে তাঁর পরিবার-সন্তানই সুখ স্বাধীনতা সব, তাঁকে কীভাবে পরাধীন বলি? সে তো এই জীবনই কামনা করেছিলো, এবং পেয়েছেও তাই। তাঁর কোনো আফসোস নেই, নেই কোনো দীর্ঘশ্বাস। তবে তাঁকে নারী স্বাধীনতার পাঠ পড়িয়ে কী লাভ! সে তো সেই জীবন একদিন বাঁচতে পারবে না।

যে যেভাবে থাকতে চায়, সেভাবে থাকতে দেওয়াই মনে হয় মানবিকতা বা আধুনিকতা। অন্যের জীবনযাত্রা নিয়ে মন্তব্য করে ফেলি আমরা খুব সহজেই। অথচ ভাবি না নিজে কি তাই করতে পারি যা বলে বেড়াই? বা সেটা করে কি আমি আসলেই সুখী? নাকি অন্যের সুখ দেখে আমরা হিংসা করি?

নারীবাদ নিয়ে এতো এতো লেখা আলোচনা-সমালোচনা, সবাই এক বুলিই আওড়াই। নারীকে স্বাধীন হতে হবে, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত হতে হবে। এই এক জিনিস পেলেই নারী মুক্তবিহঙ্গ?

ঐ যে বললাম আয় করেও ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে শুধুমাত্র মানসিক দৈন্যতার কারণে। সবাই ভাবি এই তো সে চাকরি করছে, টাকা আয় করছে, কারও উপর নির্ভর না, ব্যস হয়ে গেলো স্বাধীন। আয়ের পাশাপাশি মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তিও যে অন্যতম প্রয়োজনীয়তা, সে বলতে বেমালুম ভুলে যাই। মননে নারীবাদ বা মানতবতাবাদ না গাঁথলে উপরে শক্ত শক্ত নারীবাদের সিমেন্টে কোনো ফল আসে না।

পুরুষকে উঠতে বসতে গালাগালি দিয়ে ধুয়ে ফেলি। কিন্তু ঐ মেয়েদেরও একটু ঝারি মারা উচিত যারা মানসিকভাবে পরাধীন, ভয়ে লজ্জায় বা আবেগে। শুধু কর্ম দিয়েই দাসত্ব থেকে মুক্তি মেলে না রে বইন, চিন্তা স্বপ্ন আর মননে দাসী হয়ে থাকলে কর্ম দিয়ে দীর্ঘশ্বাস মেলে, মুক্তি নয়।

শেয়ার করুন: