বিশাল এক ব্যবধান নিয়েই শুরু যাদের চলা

জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা:

সময়-সুযোগ মিলে গেলে, প্রায়ই কোনো না কোনো ‘ম্যানেজমেন্ট কলেজ’ অথবা ‘বিজনেস ইনস্টিটিউট’-এ টার্ম ভিত্তিতে পড়াই। তো এই টার্মেও এমন একটা কলেজে পড়াচ্ছি।

এবার যেখানে পড়াচ্ছি, সেখানে হিউজ সিলেবাস। সময়ও এদিকে লিমিটেড। সুতরাং টানা লেকচার দিতে হয়, টপিক বাই টপিক। যদিও আমি এজ ইউজুয়াল, স্টুডেন্টদেরকে ইনভল্ভ করে, কারেন্ট সব এগজ্যাম্পল দিয়েই পড়াচ্ছিলাম; তবু সেদিন টের পেলাম স্টুডেন্টরা বোরড হতে শুরু করেছে। ডিসাইড করলাম, একটা ‘আউট অফ সিলেবাস’ টপিকে প্রেজেন্টেশন করাই- তাহলে সবার একটা চেঞ্জ হবে। তারা কিছুটা আনন্দও পাবে!

প্রপোজাল শুনে, স্টুডেন্টরা বেশ নড়েচড়ে বসলো। হেসে হেসে দুই মিনিটের একটা প্রেজেন্টেশনও করলো সবাই। টপিক দিয়েছিলাম: “মেলবোর্নকে ভালোবাসো? ভালোবাসলে, কেন বাসো? নিজ দেশে ফিরে গেলে, মেলবোর্নের কী মিস করবে?”

২৯ জন স্টুডেন্টের মাঝে ২৬ জন উপস্থিত ছিল সেদিন। উপস্থিত বেশির ভাগ স্টুডেন্ট ছিল কলাম্বিয়ান। বাকিদের তিনজন স্পেইনের, দুজন ব্রাজিলের, একজন আর্জেন্টিনার, একজন ভেনিজুয়েলার, দুজন চায়নার, একজন থাইল্যান্ড এর, একজন কোরিয়ার, একজন ফ্রান্সের, একজন ইতালির, দুজন পেরু’র, একজন রাশিয়ার এবং একজন জার্মানির। এদের কেউ এসেছে পার্মানেন্টলি থাকার ব্যবস্থা করতে, আবার কেউ এসেছে জাস্ট কিছুদিন এখানে থেকে দেশটা ঘুরে-ফিরে দেখে যেতে।

এনিওয়ে, যে যেই উদ্দেশ্যেই আসুক না কেন; বেশিরভাগই মেলবোর্নের চমৎকার সব দিক তুলে ধরলো; মেলবোর্নকে ভালোবাসার কারণ হিসেবে।
কেউ কেউ অবশ্য বললো, মেলবোর্নের জীবন তাদের নিজেদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি যান্ত্রিক! মেলবোর্নের এই দিকটা তাদের ভালো লাগেনি। আবার অনেকেই বললো এখানকার গুড “ল’জ এন্ড রেগুলেশন্স” এর কথা! কেউ বললো, মেলবোর্নের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ!
আমার ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের বয়সসীমা ছিল সর্বনিম্ন ২৩ থেকে সর্বোচ্চ ৪২ বছর। ছাত্রীর সংখ্যা ছিল মোট ১১জন।

প্রত্যেকেই ডিফারেন্ট ভালো লাগার ডিফারেন্ট সব টপিক নিয়ে আলোচনা করলো। কিন্তু ভীষণ অবাক হলাম, ‘নিজ দেশে ফিরে গেলে মেলবোর্নের কী মিস করবে’- এই জায়গায় এসে সব মেয়েই একবাক্যে (যেন তোতাপাখির মতো) একই কথা বললো। এবং ভীষণ অবাক কাণ্ড- কোনো ছেলেই সেটা বললো না! ছেলেরা বরং কিঞ্চিৎ অবাক হলো- মেলবোর্নকে ‘মিস করা’র এতো এতো বিষয় থাকতে ওরা সব্বাই কেন এই বিষয় নিয়েই বলছে!

হ্যাঁ, সব মেয়েই যা বলেছিলো, তাহলো – তারা এখানে যতখানি ‘নিরাপত্তা’ পেয়েছে চলতে-ফিরতে, নিজ দেশে ফিরে গেলে সেটুকু খুব মিস করবে!

বুকের ভেতরে কী যেন নড়েচড়ে উঠলো। এমন বিশেষ আহামরি ‘নিরাপদ শহর’ তো নয় মেলবোর্ন! যদিও পরপর বেশ কয়েকবার এটি বিশ্বের নাম্বার ওয়ান ‘লিভেবল সিটি’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। তবুও তো এখানেও নিউজে দেখা যায় – প্রায়ই রেইপড হচ্ছে মেয়েরা। এখানেও কখনও কখনও ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হয় ম্যারিড মেয়েরা। ফিজিক্যাল এবিউজিং এর ঘটনা এখানেও শোনা যায়।

…. তারপরও, নিশ্চয়ই পৃথিবীর অনেক অনেকগুলো দেশের তুলনায় সেইফ এখানকার রাস্তাঘাট। বিবিধ দেশ থেকে আসা এই মেয়েগুলোর সবাই যা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছে!

আধুনিক, ঝকমকে-চকমকে সুন্দর এই মেয়েগুলো আমাদের বাংলাদেশের মেয়েগুলোর মতোই (একটু কম বা বেশি) ভেতরে-বাহিরে সবসময় এক ‘অবধারিত দু:শ্চিন্তা’ নিয়েই তাহলে বড় হয়! জীবন-যুদ্ধে জয়ী হয় (কেউ কেউ নিশ্চয়ই হয়ও না)! যে দুশ্চিন্তাগুলো তাদের সমবয়সী ছেলেবন্ধুদের কল্পনারও বাইরে!

প্রশ্নোত্তর পর্বে মেয়েগুলোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘নিরাপত্তার বিষয়টা একটু এক্সপ্লেইন করতে পারবে?’ ওরা একেকজন একেকভাবে বললেও একসাইটেড সে উত্তরগুলো প্রায় এরকম, “এখানে আমরা বয়ফ্রেন্ড/হাজব্যান্ড/বাবা কিংবা আত্মীয়স্বজন ছাড়াও, একা রাত-বিরাতে রাস্তায় হেঁটে যেতে পারি! বাসে, ট্রেইনে, ট্রামে চড়তে পারি! রেস্টুরেন্ট-এ খেতে পারি! একক বাসা নিয়েও সেইফ থাকতে পারি! ইচ্ছে হলেই পুরো শহরটা চষে বেড়াতে পারি! মন খারাপ হলে এলবার্ট পার্কের বিরাট ওক গাছটার নিচে ২/৩ ঘন্টা একা শুয়ে-বসে কাটাতে পারি! দেশের জন্য মন কেমন করলে, ইয়ারা রিভারে একাই একটা ক্রুজ নিয়ে সিটি থেকে সোজা ওয়েরিবি’র হারবারে চলে যেতে পারি!”

অনেকেই হয়তো বলবেন, এ আবার এমন কোনো সিরিয়াস বিষয়?
আমি বলবো এই ‘পারা’গুলো না পারলেই যে জীবন ব্যর্থ তা নিশ্চয়ই নয়! তবু এই ‘পারা’গুলোও আসলে ‘অনেক কিছু’, আমাদের নাতিদীর্ঘ এই জীবনে। চাঁদনি রাতে দ্রবীভূত মনকে চার দেয়ালে আটকে রাখার কষ্টে ব্যস্ত কোনো মনই শুধু তা বুঝবে। সাঁতার প্রতিযোগিতায় বিশাল ব্যবধানে জেলা পর্যায়ে প্রথম হওয়া যেই মেয়েটা উপযুক্ত গার্ডিয়ানের অভাবে বিভাগীয় শহরে যেতে পারেনি সেই

মেয়েটাও বোধ করি জানবে!’উপস্থিত রচনা প্রতিযোগিতা’য় বিভাগীয় পর্যায়ে ছেলে-মেয়ে সবার মাঝে প্রথম হয়েও যে মেয়েটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় শামিল হতে পারেনি, সেও নিশ্চিতভাবেই অনুভব করবে এই ‘পারা’গুলো অনেক কিছু! এক জীবনে এই ‘পারা’ এবং ‘না পারা’র পার্থক্য আসলেই ‘অনেক কিছু’!

‘পারঙ্গমতা’র এমন এক বিশাল বৈষম্য নিয়েও চারপাশের মেয়েরা যে এতো এতো দূর আসতে পেরেছে, তাতেই আমাদের সকলের ধন্য হওয়া উচিত! তাদেরকে ফিফটি পার্সেন্ট পয়েন্টস/মার্ক্স্ এক্সট্রা দেওয়া উচিত! তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা জানানো উচিত!

আক্ষরিক অর্থেই যে এভাবে দিতে হবে, তা বলিনি! দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে – সেটাই বুঝিয়েছি!!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.