বাঙলা মুলুকের মাটি এক হলেও তাঁরা ‘মানুষ’ নয়, হিন্দু ও মুসলমান!

শেখ তাসলিমা মুন:

এই ধর্ম বড় শক্তিশালী ‘বস্তু’! ইংরেজরা খুব সহজে এটা অনুধাবন করেছিল। সাপোর্টের জন্য ইংরেজরাও মুসলিম অধ্যুষিত বাংলার সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছে। মূলত ইংরেজ শাসক প্রথম বাংলাকে ভাগ করে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য। যেন উত্তর ঢাকা, দক্ষিণ ঢাকা অনেকটা। সে বিভাগের পেছনেও ইতিহাস কম ছিল না।

মুসলিম অধ্যুষিত অংশটির ইতিহাস সহজ ইতিহাস নয়। নানান দখলদারিত্ব পার করে অ্যাবসোল্যুট ট্রান্সফরমেশন মনে হয় মুসলিম ট্রান্সফরমেশন। এ রূপান্তর যেটি করেছে তাহলো, এ গোষ্ঠীকে মূলত অন্য গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন। শুরুতেই এ গ্রুপটি ছিল পিছিয়ে থাকা একটি গ্রুপ। তাঁরা নিচু বর্ণের হিন্দু জন্ম থেকে মুক্তি পেয়ে ‘শান্তি ও সমতার’ ধর্ম বলে কথিত ইসলাম ধর্মে এসে মুসলমানই হতে পারলো বটে, কিন্তু উন্নয়নের মিছিলে ধাবমান হতে পারেনি। সেটি সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়।

এ জনগোষ্ঠীর এখনও কুরআন হাদিস ছাড়া অন্য শিক্ষা বিষয়ে আগ্রহ কম। তাঁরা তাঁদের শিক্ষা কেবল কুরআন ও হাদিসে সীমাবদ্ধ রাখার কারণে একটি বিচ্ছিন্নতা তাঁরা এড়াতে পারেনি।
বিদ্যালয় থেকে মাদ্রাসায় তাঁদের ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি বেশি দেখা যেতো, যা তাদেরকে নিজেদের ভেতর কুক্ষিগত করেছে।

অন্যদিকে হিন্দু এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ভেতর শিক্ষার আগ্রহ থাকায় তাঁরা ইংরেজি জানতো। ইংরেজ শাসকদের সাথে যোগাযোগে তাঁরা অনেক বেশি এগিয়ে ছিল।

আগে থেকেই হিন্দুরা জমিদার থাকায় পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ছিল রাজা-প্রজা সম্পর্ক। এখানে একটি প্রকট শ্রেণি বৈষম্য এবং শ্রেণি পার্থক্য ছিল। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে সে কারণে কোনকালে সমতা ছিল না।
ওদিকে সাম্প্রদায়িকতা প্রভাবিত হিন্দু সিভিল সোসাইটি রোল যে জাতি বিদ্বেষে ভূমিকা রাখেনি, তাইবা কীভাবে বলি? তারা বারবার হিন্দুবাদী শাসনের প্রবক্তা হয়ে মুসলমানদের তাদের অনেক আন্দোলনে পায়নি।

যেমন ‘বন্দেমাতরম’ গানটি নেওয়া হলো বঙ্কিমের আনন্দমঠ থেকে। যা কিনা জাতি বিদ্বেষে দুষ্ট। বা যেখানে মুসলিমদের হাতে হিন্দুদেরকে অবদমনের কথা। এখন এ গানটিতে মুসলমানরা একাত্ম হতে না পারলে এ দায়িত্ব হিন্দু সিভিল সোসাইটিরও কম নয়। আর মুসলিমদের এই ট্রাডিশনাল শিক্ষা বিমুখতার জন্য কি তাদের ধর্মকে দায়ী না করে পারা যায়?

একথা সত্য নয় যে মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য তখন বিদ্যাপীঠ নির্মাণ হয়নি। তাদের অনুপস্থিতি ছিল প্রকট। মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবণতা এ মুলুকে এখনও প্রকট, যা মাঝে মাঝে ধর্মীয় সীমা লঙ্ঘন করে জঙ্গিবাদের অভিযোগ এড়াতে পারছে না। অন্যদিকে হিন্দু জনগণ তাদের প্রাচীন ‘টোল’ শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেক আগে।

হিন্দুরা যখন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে, তখন মুসলিম এলিট সম্প্রদায় নিজেদের জন্য আলাদা নির্বাচন দাবি করে। তাঁরা তাদের আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন নিয়ে ভাবেনি। নিজেদের সংস্কার নিয়ে ভাবেনি। তাঁরা বুঝতে পেরেছে ইসলামিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা এ সম্প্রদায়কে কঠিন হবে। তাঁরা মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা নির্বাচন, আলাদা শাসন এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দাবি করে। অর্থাৎ মুসলিমদের জন্য মুসলিম শাসন, শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিফলন আমরা তখনই দেখি, উন্নয়নের জন্য নয়, বরং বিচ্ছিন্নতার জন্য। নিজেদের শাসন অভিলাষে। এর অব্যবহিত পরেই মুসলিমদের জন্য নিজস্ব রাজনৈতিক দলও গঠন করা হয়।

শাসক চরিত্রে শতাব্দী শতাব্দী পরেও কিছু মিল থেকে যায়। আজ যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মুসলিম ভোট গণনা করে মৌলবাদ তোষণ করে এটা আমরা ইংরেজ শাসকদের ভেতরও দেখি। তারা যখন জনগণনা করতে পারলো তখন দেখলো পরিমাণে এদের সংখ্যা কম নয়। মুসলিমদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না করতে পারলেও তাদের জনসংখ্যা বিবেচনায় তাদেরকে সমীহ করতে থাকে। ইংরেজরা মুসলমান উচ্চবিত্তদের সাথে যোগাযোগ মেইন্টেইন করে। মুসলমানদের ক্ষমতালাভকে সামনে রেখেই এ বিভাজনের পত্তন করা হয়।

এরপর ‘পানি’ ও ‘জল’ বহুদূর গড়িয়ে গেছে। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মুসলিম জাতীয়তাবাদ বাঙালি মুসলমানদের ঘাড়ে চেপে থাকার অভ্যন্তর থেকে আরও একটি পুঁজিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল সেক্যুলার দলের জন্ম নেওয়া কম বড় ঘটনা ছিল না। তবু তাদের ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিতে সময় লেগেছিল। আওয়ামী-মুসলিম লীগ বা মুসলিম-আওয়ামী লীগ থেকে ‘মুসলিম’ সাফিক্স প্রেফিক্সের লেজুড় কাটা সম্ভব হয়েছিল বোধ করি পাকিস্তানের সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক অমিল জানার পর থেকে। মুসলমান হলেও আমরা যে পাকিস্তান থেকে ভিন্ন প্রকৃতির, সেটি বুঝতে বেশি সময় লাগেনি।

আমরা ওবাংলার হিন্দুদের সাথে রেষারেষি, দ্বন্দ্ব, বা রায়টে অভ্যস্ত থাকলেও পাকিস্তানের সাথে কোনমতেই এক জাতি ছিলাম না। দ্বন্দ্ব রায়ট করতেও পরস্পরকে চেনা দরকার হয়। পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের সে পরিচয় ছিল না। ফলে খুব বেশি সময় লাগেনি পাকিস্তানের সাথে আমাদের বৈসাদৃশ্য অনুধাবন করতে। আর তার সাথে যোগ হয়েছিল পাকিস্তানের এ মুলুকে উপনিবেশবাদ।

পাকিস্তানের অংশ হলেও বাঙালিদের তাঁরা ঘৃণা করেছে ১০০%। তাদের জুলুম নিপীড়নের কারণেই একটি প্রগতিশীল মুসলিম জনতা সেক্যুলারিজমের স্বপ্ন দেখেছে। আলাদা একটি রাষ্ট্রের কথা ভেবেছে, যা সবকিছু কিন্তু ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ নয়। আমার মনে হয় এই ‘মুসলিম রাষ্ট্র’, ‘মুসলিম দল’ তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে গিয়েছিল। তারা অনুভব করেছিল জাতিগত বিভাজনে এ ধর্মীয় শব্দগুলোর মূল্য তাদের কীভাবে দিতে হয়েছে। তাঁরা বুঝেছিল এগুলো থেকে বেরিয়ে ‘বাঙালি’ পরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। সে পরিচয় অনেক বেশি আপন এবং ‘সভ্য’।

কিন্তু ‘সংখ্যাগরিষ্ট’ বিষয়টি জটিল এবং ততটা ‘সভ্য’ নয়। ‘বাঙালি’ পরিচয় এতো সহজ এ এলাকার মানুষের জন্য কোনদিন ছিল না। ‘হিন্দু’ জুজুর ভয় কোমরে হাঁটে। ‘বাঙালি হলে হিন্দু হয়ে যেতে হবে’ – ধারণা রোপণ করা কিন্তু ১৯৭৫ সালের ইতিহাস নয়, তারও অনেক আগের। সেই ইংরেজ আমল থেকেই। যত হিন্দু বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে বা ছড়ানোর কারণও তখনকার হিন্দু এলিটরা তৈরি করেছে, তত তারা ‘মুসলিম’ পরিচয়কে আঁকড়ে ধরেছে। এমনকি শিক্ষার প্রতি অনীহা যে মুসলমানদের ভেতর পরিলক্ষিত হতো, সেটিও ‘বাঙলা বা ইংরেজি শিখলে হিন্দু ও বিধর্মী হয়ে যেতে হবে’ এমন মনোভাব কাজ করেছে। ওদিকে মুসলমানদের পুনরায় হিন্দু করা হোক এমন প্রবক্তারও অভাব ছিল না তখনকার হিন্দুবাদী নেতাদের।

এ এলাকার শংকা ও সন্দেহের বিদ্বেষ এ জাতির ভেতর এমনভাবে প্রোথিত যে ক্ষমতা দখলের সুবিধা হিসেবে সকল শাসক এ অঞ্চলে জনগণকে এ ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতা পোক্ত করেছে। একমাত্র বঙ্গবন্ধুই মনে হয় সেটা থেকে বাঁচার জন্য সমাজতন্ত্রের আদলে বাকশালকে একটি অল্টারনেটিভ হিসেবে নিয়েছিলেন। আর তার জন্য তার জীবন দিতে হয়েছিল। আর তাঁর মেয়ে ২১ বছর বুকে হেঁটে ক্ষমতার সন্ধান পেয়ে বাবা যে ভুল করেছিলেন তা শুধরানোর এমন পথ অবলম্বন করেছেন যে আজ আর আমরা নিজেদেরই চিনতে পারি না। বঙ্গবন্ধুর ছবিতে রেকর্ডকৃত ভাষণে ক্ষমতার মার্কেট ছয়লাব, কিন্তু দেশ ও জাতির দিক চলছে অন্ধকারের তিমিরে। আজ আর আমরা কেবল ‘বাঙালি মুসলিম’ না। খেজুর বিধৌত পাক-মুসলিম।

বাঙলা মুলুক আর কোনদিন ‘বাঙালি’ জাতি স্বত্বায় এক হতে পারবে এমন আশা অন্তত আমি দেখি না।

শেয়ার করুন: