সাবরিনা স. সেঁজুতি:
অনিতার কোনো ছেলেই পছন্দ হচ্ছে না। বিয়ের কথাবার্তা কিছু দূর এগিয়ে আর এগুচ্ছে না। আসলে আগানো সম্ভব হচ্ছে না। এইতো কিছুদিন আগের কথা, এক ছেলের সাথে বিয়ের কথা পাত্র-পাত্রী দেখা-দেখি পর্যন্ত গড়িয়েছিল, কিন্তু শেষমেষ দেখাদেখিতেই ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড যা বেরুলো…! বিয়ের কথাবার্তা আর এগুলো কোথায় বলুন? চলুন শুনে আসি সে গল্প।
শুরুতেই বলে নেয়া ভালো, ছেলে পাত্র ভালো, আশেপাশের লোকজন সেরকমই জানিয়েছিল। অনিতার সাথে অনিতার ভাবীর বর্ণনা জুড়ে দিলে গল্পটা হয়তো এরকমই হবে:
পাত্রের নাম ফরহাদ, বয়স ৩৩ ছুঁই ছুঁই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে বেশ কয়েক বছর কিন্তু চাকরিতে পদোন্নতির মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি এখনো। তবে পদোন্নতি না হলেও চোখ নাক মুখ খোলা রাখলে দুই পয়সা সরিয়ে ফেলার ভালো সুযোগ পেয়েছে সে। এই উপরি উপার্জনের কথা চিন্তা করেই চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছে না ফরহাদ। অনেকেরই ধারণা উপরি উপার্জন শুধু সরকারি চাকুরিতেই সম্ভব, তবে বেসরকারি চাকরিতেও দুই-এক পয়সা মেরে দেয়ার সুযোগ যে নাই, তা নয়। আর সে ব্যাপারে ফরহাদও ভালো দক্ষতা অর্জন করেছে।
ফরহাদের জীবনে সমস্যা একটাই, সঠিক সময়ে সঠিক জীবন সঙ্গিনী খুঁজে পাচ্ছে না সে। চেহারা সুরত যে একেবারে খারাপ তা নয় । হাইটটা বিয়ের বাজারে একটু কম বটে, তবে সেটাই মূল সমস্যা কিনা ফরহাদ জানে না।
ফরহাদের বাবা নেই, মা স্কুলের মাস্টার, তিন ভাইবোনের মধ্যে সে মেজো। তাই সংসারের দায়িত্ব সে নেয় না, সে মনে করে সংসারের দায়িত্বটা বড় ভাইয়েরই নেয়া উচিৎ আর মা যেহেতু প্রায়ই অসুস্থ থাকে তাই রান্না ঘরের দায়িত্বটা নেয়া উচিৎ তার ছোট বোনের। তবে সে মনে করলে কী আর হবে, তার ভাই-বোন সেরকম মনে করলে তো হতোই!
তাতে অবশ্য ফরহাদ থোড়াই কেয়ার করে। মাসের প্রথমে বেতন পেয়ে টুকটাক বাজার সদাই করে দেয় বাসায়, তারপর হাতে যে টাকা থাকে তা দিয়ে রাজার হালে চলে যায় তার পুরো মাস।
বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘোরাফেরা থেকে শুরু করে সপ্তাহে অন্তত একদিন অফিস পাড়ার বারে বসে তিন-চার পেগ গেলা আর মাসে একদিন কল-গার্লের সঙ্গ কেনার আর্থিক সক্ষমতা তার আছে। ইদানিং সিগারেটের হালকা নেশা হয়েছে বটে তবে তার খরচও সে সামলে উঠতে পারে বিনাকষ্টে। তাই ফরহাদের ইচ্ছা চাকরি করা বউ ঘরে তুলবে। যাতে বিয়েশাদি হলে হাত টান না পড়ে তার বিনোদনে।
অফিসের দুই একজন সুন্দরীর সাথে যে সে ভাজ দেয়নি তা নয়, তবে কথা বেশি দূর গড়ায়নি।
ফরহাদের মতে,“বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মেয়েগুলো বেহায়া টাইপের হয়, আর খুব বেশি খুঁতখুতে, এদের সাথে প্রেম কিংবা পরকীয়া করা চলে, কিন্তু বিয়ে? প্রশ্নই উঠে না।“
তাই ফরহাদ তাদের সাথে চুটিয়ে কয়েকদিন প্রেম করে ঠিকই, কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে দেয় না সম্পর্ক। মজার বিষয় হলো, তাদের মধ্যে কয়েকজন সাথে বিয়ের পরও সে ঠিকঠাক সম্পর্ক ধরে রেখেছে।
এই তো গত মাসেই মুনিয়ার সাথে বালি-তে ঘুরে আসলো ফরহাদ। অফিসের কাজে একটা সেমিনারে গিয়েছিল তারা একসাথে। মুনিয়ার একাই যাবার কথা ছিল। ফরহাদ এইচআরডি-র এক বড়-ভাইকে ভজিয়ে ম্যানেজ করেছিল ট্রিপটা। সেমিনার ছিল মোটে আধা বেলার, ফরহাদ-মুনিয়া ঘুরে এসেছে পুরো ৫ দিন।
ফরহাদ একটা কথা মনে মনে ভেবে প্রায়ই হাসে, তা হলো “প্রতিষ্ঠানের এইচআরডি মানেই কি মাথার মধ্যে গু? নিজেদের কাজ করে কম, আর অন্যের পশ্চাতদেশে লেগে আছে সারাক্ষণ। কারণ ভালোমতো পলিসি-টলিসি দেখে এপ্লিকেশন পাশ করলে, ফরহাদের ঐ সেমিনারের যাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না”।
সে যাই হোক, মজার বিষয়টা হলো, বালি থেকে ফিরে এসেই মুনিয়ার বিয়ে হয়ে গেল। তাই পাঁচ দিনের গল্প ধামাচাপা পড়ে গেল, ফরহাদও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
আর আজ ফরহাদ যাচ্ছে তার নিজের জন্য পাত্রী দেখতে। রুটিন করে মাসে একবার অবশ্যই পাত্রী দেখতে যায় সে। সারা মাস পাত্রীর বায়োডাটা, ছবি, সামাজিক মাধ্যম ইত্যাদি দেখে যেটা সবচেয়ে ভালো মানের মনে হয় সেটা দেখতে যায়।
আজকে তার সেই দিন। গত তিন সপ্তাহ ধরে এই মেয়ের সম্পর্কে খোঁজ খবর করছে সে। দুই একটা বন্ধু বান্ধবকেও মেয়ের পেছনে লাগিয়েছে তথ্য বের করতে। এখন পর্যন্ত তেমন কোন নেগেটিভ রিপোর্ট পায় নাই।
বন্ধুরা জানিয়েছে, “মেয়ে সাদাসিদা গোছের । মাত্রই একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কাজ নিয়েছে। স্যালারিও খারাপ না, ঠিক ফরহাদ যেমন চায়”।
প্রস্তাবটা এনেছে ফরহাদের বড় খালা, সে বলেছে, “মেয়ের বাপের ভালো পয়সা আছে, ছেলে পছন্দ হলে ভরায় দিবে এখন খালি প্রতীক্ষা যেন মেয়ে পাত্র পছন্দ করে”।
পাত্রী ভজাতে যাবে বলে সকালেই ভালো শার্ট, প্যান্ট আর চকচকা শু পড়ে এসেছে ফরহাদ। গোবেচারা চেহারাটা ফুটিয়ে তুলেছে নিজের মধ্যে। ল্যাপটপের ব্যাগে রাখা বডি স্প্রেটা গায়ে মেখে সিএনজি থেকে নেমেই ফোন দিল ফরহাদ বড় খালাকে। এমনিতে ফরহাদ একাই যায় পাত্রী দেখতে, কিন্তু আজ তার বড়ো খালা গো ধরলো। খালা ফোন ধরে বললো, সে ভিতরে। ফরহাদও ঢুকে পড়লো। দূর থেকে দেখে বুঝলো পাত্রী এসে গেছে। মেয়ের সাথে মেয়ের বান্ধবী বা ভাবীও এসেছে।
পেছন থেকে দেখে ফরহাদ মনে মনে ভাবলো, “দুইটাই খাসা মাল” ।
যাই হোক সে এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই ফরহাদের চোখ চড়ক গাছ। মেয়ের সাথে যে এসেছে সে আর কেউ না, সে ফরহাদের পুরাতন প্রেমিকা এবং কলিগ। খালা জানালো সে পাত্রীর ভাবী। এক বছরের মতো প্রেম করেছিল ফরহাদ এই কলিগের সাথে। রমরমা প্রেম। মেয়ে বিয়ে করার জন্যও রাজি ছিল।
কিন্তু ঐ যে ফরহাদের এক ফিলোসফি, “অফিসের মেয়েদের সাথে প্রেম চলে বিয়ে না”, সেই বিশ্বাস থেকে, পরে সম্পর্কটা আর আগাতে দেয়নি সে। পাছে লোকে ফরহাদকে প্রতারক ভাবে তাই মেয়ের নামে ছোট্ট একটা গুজব রটিয়েছিল সে অফিসে যে এই মেয়ে আগেও একবার পালিয়ে বিয়ে করেছিল যেটা টিকে নাই। তাতেই কাজ হয়েছে। পরে মেয়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়, চাকরীও ছেড়ে দেয়। প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা। ফরহাদের মতে, বিরাট গাধা টাইপের মেয়ে ছিল, তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো। ফরহাদ শুধু সুযোগের সদব্যবহার করেছে।
কিন্তু এই মেয়ে এখানে, তাও আবার মেয়ের ভাবী, এবার ফরহাদের একটু একটু ঘাম হতে শুরু করলো, মনে মনে ভাবলো, “সোনার ডিম পাড়া মেয়েটা হাত ছাড়া হয়ে গেলো, বিয়েতে ওর কুফা লেগেছে”। তাই কথা না বাড়িয়ে খালাকে ইশারায় বাইরে আসতে বললো।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে খালা জিজ্ঞাসা করলো, “ঘটনা কী?”
ফরহাদ বললো, “আমার মনে হয় কথা বেশি দূর আগাবে না।“
খালা জিজ্ঞাসা করলো, ‘কেন?’
ফরহাদ বলল, আমি পাত্রীর ভাবীকে চিনি, সুবিধার না। মেয়ে সম্পর্কেও খোঁজ করেছি, মেয়ের চালচলনও ভালো না। তুমি অন্য পাত্রী দেখ”।
খালা রেগে বললো, তাহলে আসার আগে কেন বললি না? অদ্ভুত তো! বলেই খালা রেস্টুরেন্টে ফিরে যাবার উদ্যোগ নিলো।
ফরহাদ আর গেল না, সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়ে, মনে মনে পুরানা প্রেমিকাকে গালি দিতে দিতে রিক্সা ডাকলো।
রিক্সায় উঠে খেয়াল করলো, পাত্রী মানে অনিতা, রেস্টুরেন্টের দরজায় দাঁড়িয়ে। হয়তো সব শুনেই ফেলেছে। এবার ফরহাদ আরো বিরক্ত হলো।
অনিতাও বুঝলো এসব ভালো পাত্রগুলোর কারণেই তার বিয়ে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে।