‘তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা’

অপ্সরী নন্দনা:

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী – বাংলাদেশের কাছে নামটি সাহসিকতার, অনুপ্রেরণার, প্রতিবাদের এবং একটি ইতিহাসের প্রতীক। কিন্তু আমার কাছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী নামটি সম্পূর্ণ আলাদা অর্থ বহন করে। আমার কাছে নামটি বন্ধুত্বের ও ভালোবাসার – বটের ছায়া হয়ে যে আমাদের সবাইকে আগলে রাখতো। নানী ছিল আমার আলোর জানালা, জীবনের প্রথম এবং পরম বন্ধু। আমার হাসি-কান্না, আনন্দ- বেদনাকে তাঁর মতো করে কেউ বুঝতো না।

আমাদের বন্ধুত্ব ছিল খুব সাদাসিধে আর বাধাহীন। ঝগড়াঝাঁটিও হতো মাঝেমধ্যে। একটুপরেই তা ভুলে গিয়ে হাসাহাসি করতাম। নানীর কাছ থেকেই জেনেছি, বন্ধুত্বের কোনো বয়স নেই – বন্ধুত্ব হয় মন থেকে। অনেক সময় মাকেও যা বলিনি, নানীকে বলেছি মন খুলে। মনের সব কথা তো তাঁকেই বলা যায়! নানীও নিজের কথা আমায় বলতো, বয়সে ছোট বলে কখনো দ্বিধা করেনি।

নানীর বাড়ি এলে আমি সারাক্ষণ তাঁর কাছাকাছি থাকতাম, আর কিছুই ভাবতে পারতাম না। আসার সময় আমার ছোট বোন ঊর্বশী আর আমি সারা সপ্তাহের জমানো নতুন সব গল্প, খবর আর রাজ্যের নালিশ সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম। নানী ধৈর্য্য ধরে সব শুনতো।
ভালুক আর নানীর ঝগড়া নিয়ে মজার সব কাণ্ড হতো। দেখা যেতো ঊর্বশী সবসময় ভালুকের পক্ষ নিতো, আর আমি যথারীতি নানীর দলে।

স্কুলে যখন কেউ জানতে চাইতো আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে – আমি বলতাম, আমার নানী আমার সেরা বন্ধু। নানী আমাকে তাঁর সাথে অনেক অনুষ্ঠানে নিতে চাইতো। অনুষ্ঠানের জন্য তাঁকে সাজানো, শাড়ি – মালা বেছে দেয়া ছিল আমার আর ঊর্বশীর নিত্যদিনের দায়িত্ব। নানীর হাতের রান্না ডাল- ভাতও আমাদের কাছে অমৃতের মতো লাগতো। আচারের তো তুলনা ছিলোনা। আমি শুধু বলতাম, নানী, আবার কবে গুড়ের পায়েস বানাবে?

আমি ছিলাম নানীর “শিশু ভোলানাথ।” আদর করে ভোলা, ভুলি এমন নামেই আমায় ডাকতো।বাড়ির অন্য কারো সাথে মনোমালিন্য হলে কেন যেন নানী বেশিরভাগ সময়ই আমাকে কোলে টেনে বলতো, ” থাক না! আমার ভোলাটাকে তোমরা আর বকা দিও না। ” আমার তখন মনে হতো, বন্ধু তো এমনই হয়!

খাবার টেবিলে আমার বসার জায়গা ছিল নানীর ঠিক পাশের চেয়ারে। এই জায়গাটা সহজে আমি ছাড়তাম না। যদি কোনো একদিন না বসা হতো, মনে হতো ইস্! খাওয়াটাই যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল!

একটু করে বড় হবার সাথেসাথে লেখাপড়ার চাপ বাড়তে লাগলো। কিছুদিন না আসতে পারলে অস্থির লাগতো। তাঁর সাথে যে আত্মার সম্পর্ক! নানীর বাড়িটা আমার কাছে পৃথিবীর মধ্যে এক টুকরো স্বর্গ মনে হতো। এতো আনন্দ আর কিছুতেই কখনো পাবো না। সেই বাড়িতেই এখন আমরা থাকি। কেবল নানী নেই। এমনও কী সম্ভব?

মা প্রায়ই বলতো, “ভাগ্য করে এমন নানী পেয়েছো”। তখন ভালোভাবে বুঝতাম না। এখন বুঝি সত্যিই আমি কত ভাগ্যবান! শুধু এজন্যই না যে আমি প্রিয়ভাষিণীর নাতনী। বরং এজন্য যে আমার জীবনের প্রথম বন্ধুর নাম প্রিয়ভাষিণী। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, বইতে, খবরের কাগজে পড়েছি, নাটক সিনেমায় দেখেছি। নানীর কাছ থেকে জেনেছি কেমন করে পেয়েছি এই বাংলাদেশ। জেনেছি মাতৃভূমিকে ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই। মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে শান্তির কিছু নেই।

আমার নানী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী যেন আমার মুক্তিযুদ্ধ, আমার প্রিয় বাংলাদেশ।

নানী, আমি জানি আমি তোমাকে আর দেখতে পাবো না, কাছে পাবো না, তোমার সাথে সময় কাটাতে পারবো না, তোমার “ভোলানাথ” ডাকটাও শুনতে পাবো না। কিন্তু তুমি সবসময় আমার আত্মার সাথে, শরীরের সাথে মিশে আছো। তোমার সাথে আবার দেখা হবে মেঘপরীদের বাগানে, ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকবো, তুমিও তাই থেকো। ভালো থেকো নানী।

ইতি
তোমার ভোলা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.