অশ্রু-শিশির-স্বেদ-রক্তক্ষরণে মাথা উঁচু করা নারীর আত্মসম্মান

শেখ তাসলিমা মুন:

শক্ত ইস্পাতের নার্ভে গড়া নারীর কান্না রাতের গভীরে আকাশ আর দূর পর্বতের পরতে পরতে লেখা থাকে। তাদের কান্না নিজের জন্য। এ কান্না কারও কাঁধ ভেজানো কান্না নয়। নিভৃতে একাকী। তবু এ কান্না দরকারি। আত্মসম্মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের মতো সুউচ্চ হয়েও কান্না তাকে মানায়। এ অশ্রু বিসর্জনে তার অধিকার।

কেন বলছিলাম এ কথা! মেয়েটি পেরেক ওঠা স্যান্ডেল পায়ে হেঁটে যায়। হাঁটতে হাঁটতে সে ভুলে যায় কীভাবে শুরু হয়েছিল এ দুর্গম পথচলা। পেরেকে আঙুল ছড়ে রক্তাক্ত পা তাকে থামাতে পারে না। সে ক্লান্তিহীন পথ চলে। তার আত্মসম্মানের গল্প না বলাই থেকে যায়। অথচ রক্তাক্ত একাকী যুদ্ধ তার সবসময়ের ছিল না। কোনো একদিন কেউ ছিল, বেশ হাস্যরসে ভরপুর কোনো জনপ্রিয় মানুষ এবং অবশ্যই পুরুষ। ‘মানুষটির তুলনা হয় না’।

নারী এবং পুরুষের প্রেম এবং সে প্রেমের সমাপ্তিতে হঠাৎ করে নারীর উপর যেভাবে সব দায়িত্ব বর্তায়, পুরুষের জন্য সেভাবে বর্তায় না। একই অ্যাক্টের জন্য নারীর উপর যে ভারি পাথর চেপে আসে, পুরুষের জন্য তা নয়। প্রেম প্রত্যেক সুস্থ নারী এবং পুরুষের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক হেলদি একটি আচরণ। একে অপরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা, কাছাকাছি আসা, যুগলবন্দী হওয়া কারও জন্যই অস্বাভাবিক নয়। উভয়ের আকর্ষণে তারা কাছাকাছি আসে। সে কাছাকাছির কিছু ফলাফল রয়েছে। একত্রবাস। সন্তান। ঘরকন্না। একটি পর্যায়ে মতভেদ, বিভেদ এবং ভুল শুধরানোর প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া একেজনের জন্য একেক রকম।

তবু দেখা যায়, সকল সঙ্কটে নারী কখনও তার দায়িত্ব থেকে পিছপা হতে পারে না। যৌথ কর্মের ফলাফলের পাহাড় সমান দায়িত্ব কেবল তার কাঁধেই অর্পিত হয়। মেয়েটি ছেঁড়া স্যান্ডেলে খুঁড়িয়ে যখন সামনে একজন মুচির দোকান খোঁজে, পুরুষটি তখন দামী সেলুনে চুল দাঁড়ি কেটে, সেভিং ক্রিম আর লোসনে গাল পরখ করে রঙিন শার্টে খোলা রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।

একই ঘটনার দুজনের জীবনে দুরকম দৃশ্য ও বার্তা বহন করে।

একই ঘটনা, কিন্তু নারীর উপর কেবল দায়িত্ব নয়, চেপে বসে ব্যর্থতার দায়। তার যাবতীয় অক্ষমতা, অপরাধ, কুৎসা আর অনাকর্ষণের সকল রূপকথা মাথায় নিয়ে সে রাস্তায় নামে। আর পুরুষের জন্য তখন সহানুভূতি, সহমর্মিতা আর বন্ধু, স্বজনদের আহাজারি, জীবনটা তার এমন বেঘোরেই গেল। ‘আগেই জানা ছিল এমন যে হবে’। ‘ঐ মেয়েটা দেখে তারা আগেই বুঝতে পেরেছিল’। ‘যা হবার হয়েছে,’ ‘পুরুষ মানুষের এমন হতেই পারে’ ‘আবার শুরু করো’।

নারীর স্বজনেরা তখন ভিন্ন কথা বলে। ‘কারও কোন সমস্যা হয় না, তোমার কেন এতো সমস্যা?’ ‘তোমার জন্য আমাদের পরিবারের সম্মান রাস্তায় নেমে গেছে’। আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখানোর উপায় নাই। ‘মেয়ে হলে সহ্য ক্ষমতা অনেক বাড়াতে হয়।’

নারী, নতুন সংসার শুরু করার ভাবনাও তার জন্য এক অসম্ভব ঘটনা। সে এক দণ্ডিত নারী। সিল মারা। সারাদিন পরিশ্রম। বিকেলে এক্সট্রা জব। বাচ্চাদের জন্য একটু পুষ্টি, স্কুলের বেতন নিয়ে ভাবতে গিয়ে হারিয়ে গেছে তার জীবনের রঙ। শরীর এখনও এক টুকরো শ্যামল মাটি, একটি কুলু কুলু বয়ে যাওয়া ঝর্ণা। সবটাই অলীক গল্প। কোথাও কোনো অসঙ্গতি ছিল না। শরীরে ঝর্ণা ছিল। মননে পেলব পাপড়ির লাবণ্য ছিল। প্রেম ও আকর্ষণ সবটাই ছিল। তবু দণ্ডিত এক নারী ভিড় হয়ে মিশে যায় প্রতিদিন। সে আর এক নারীই নয়, একজন ‘জীবন সংগ্রামী’ মা। একজন কর্মক্লান্ত হাউজহোল্ডার, কর্মক্ষেত্রে পরিশ্রমী কর্মী। নারীর এ রূপটি ঠিক ‘প্রেমিকা’ রূপ হিসেবে বিগলিত হয়ে ওঠে না।

আর পুরুষটি? সদ্য অ্যাক্ট্রাকটিভ সিংগেল, ভালনারেবল, এক্সট্রা সংবেদনশীল। তাকে টেক কেয়ার করার জন্য অনেক মানুষ। আত্মীয় স্বজনের বিয়ের জন্য ছুটোছুটি। আজকাল কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে একটু বেশী বিনয়ী বিষণ্ণ বসে থাকতে দেখা যায়। এমন পুরুষের দুঃখ মানুষের সহ্য হয় না। অফিসের দু একজন নারী সহকর্মীও একটু বেশিই খোঁজ খবর নেয়।

মেয়েটির কিছু বিবাহিত সহকর্মী তার পেছনে লেগেছে। প্রায়ই চোখে এক নোংরা ইঙ্গিত। অপমানে নীল হয়ে ওঠে সে। শক্ত ইস্পাতের মতো মুখ আর চোয়াল বর্ম বানিয়ে কাজ করতে করতে মুখের চেহারাটাই ইস্পাত পাথর গেছে তার। কবে একটি মায়াবী পেলবতা খেলে যেতো এ মুখে, সে নিজেই ভুলে গেছে। খুব নির্জন মুহূর্তেও তার শরীরের পেশীগুলো শক্ত হয়ে থাকে।

এ যুদ্ধ তাকে চালিয়ে নিতেই হয়। এ তার দায়িত্ব। পাশে কেউ নেই। তবে যুদ্ধ আছে। সে যুদ্ধ থেকে সে সরে যায় না। তার দায়িত্ব সে এক মুহূর্তের জন্যও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে না। এ তার নিজের কাজের প্রতি নিজের সম্মান এবং দায়বদ্ধতা। এই দায়বদ্ধতার আরেক পরিচয় সে মানুষ। সে দায়িত্বশীল মানুষ। সে পরাজয় মানে না। অশ্রু-শিশির-স্বেদ-রক্তক্ষরণের উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে তার মানবজন্ম, তার আত্মসম্মান। এবং সে এক নারী।

শেয়ার করুন: