তোতা কল্পকাহিনী

বহ্নি শিখা:

(ঘটনা ১৯৩৭ সাল; কাল্পনিক)

আট বছরের তোতা বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত তার ভালো নাম কী, তা জানতো না। এটা আকিকা’র দিন মনে হয় হুজুরের কানে কানে বলেই শেষ। বিয়ের দিন তোতাকে বারো হাতের শাড়ি প্যাঁচিয়ে পরিয়ে বসায় রাখে, বাবজান আরো ক’জন মুরুব্বিসহ জানতে চায়, আঞ্জুমান আরা বেগম, বিয়েতে রাজি? কবুল কও, কবুল।

তোতাকে তো মা আগেই শিখিয়ে দিয়েছে, কবুল যখন বলতে বলবে, বলবি, কবুল কবুল কবুল, তিনবার। তোতা আনজুমান আরা বেগম নাম শুনেই প্রথমে ভ্যাবাচেকা খায়।

কারে কয়? ওরা কারা!?
শেষে বাবজান বলে,
-তোতা মা, কবুল বল।
তখন সে তোতা পাখির মতোই মুখস্ত করা বুলি বলে,
– কবুল কবুল কবুল।

বিয়ে কী তা তোতা জানে না, তবে বিয়ের পর আর নিজের ঘরে থাকতে পারবে না, সেটা খুব ভালো বুঝতে পেরেছে। বান্ধবী আলমাসেরও সাতদিন হয় বিয়ে হয়েছে। পরশু বাপের বাড়ি এসেই কী কান্না-
– কুত্তার জামাই অনেক ব্যথা দিছে, কাল রাতে থাপ্পরও মারছে।
আর যাবে না সে শ্বশুর বাড়ি, এখানে তোতার সাথে খেলবে। ওর মা কোলে নিয়ে বলে,
-চুপ আলমাস চুপ৷ অলক্ষুণে কথা কইতে নাই। দু’দিন পর তোর বান্ধবী, তোতাও যাবে শ্বশুরবাড়ি।

গতকাল, তোতাকে এসে আলমাস বলে,
– তোতা যাইস না, শ্বশুরবাড়ি পঁচা।
আসলেই কি পঁচা! মা যে বললো, ভালো! এখন তো যেতেই হবে, কবুল বলে ফেলেছে। কবুল বললে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়, তোতা জানে।

সপ্তাহ’র ভেতর পর পর দুই বিয়ে। সবাই কানাঘুষো করতে থাকে, আলমাসের জামাই বেশি ছোকরা, ষোল-সতেরো বয়স। আর তোতা’র জামাই কুড়ি বছর, একেবারে বিয়ের খাঁটি বয়স। আর দেখতেও চাঁদের লাহান। মিলছে তোতা’র লগে।

তোতা মনে মনে খুব খুশি হয়। কিন্তু জামাই বেশি বড়, ওর ভয় ভয় লাগে। তোতা জামাই’র কোমরে পরে থাকে৷ তোতা’র একুশ বছর বয়সী মাকে যখন ওর জামাই নুরুজ্জামান পা ছুঁয়ে সালাম করে, তোতা’র হাসি পায়। ওর মা আর জামাই, ওরা নাকি এক সময় একই মক্তবে আমপারা পড়ছে। বিদায়ের সময় মা “তোতারে” বলে চিৎকার দিয়ে যখন কাঁদন ধরছে, তোতা’র একটু কান্না পায়ছিলো। কিন্তু কান্নার কী আছে, খালার ওখানে দশ, বারদিন থাকছে, তখন তো মা কাঁদে নাই। আর আলমাসের মতো পাঁচদিন পরই তো ও আবার আসবে৷

তোতা প্রায় কান্নাকাটি ছাড়াই নৌকা করে নদী পাড় হয়ে সামান্য কিছু হেঁটে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। ওর এমন বেড়ানোতে মজাই লাগছে। সাথে পেছন পেছন গ্রামের অনেক পোলাপানও আসে। কারো কারো হাতে বাপের দেয়া পাটি, হাত পাখা, বদনা, দুইটা বালিশ আরো কীসব৷ এসব দিতে হয়।

ওমা কত মানুষে ঘর ভর্তি, সবাই বৌ দেখতে আসছে!
-“কিরে, বৌ তো কান্দে না”, কেউ কেউ বলে।
-ক্যান কাঁদবো, সোনার চান শিক্ষিত পোলা তার সোয়ামী; দশ জনমের ভাগ্য তার।
কেউ বলেন,
-নাম কী তোমার?
নাম বলতে যাবে অমনি আরেকজন বলে,
-বিয়ের পর আবার নাম কি, নুরুর বৌ কও।

কেউ কেউ শাড়ি আনছে, কেউ দিছে পয়সা। গুনে দেখতে হবে সব মিলে দুই টাকা কি হবে? “ওমা, এত্তো টাকা!
রোজ রোজ বিয়ে হলে কী হয়?” ভাবে তোতা।
আলমাস মিছে কথা বললো কেনো, এও ভাবে সে। শ্বশুরবাড়ি তো অতো খারাপ না, বরং ভালোই। শাশুড়ি তোতা’র মায়ের চেয়ে বয়সে অনেক বড়, পান খেয়ে ঠোঁট টকটকে লাল করে রেখেছে। তোতা’র কাছে ওর জ্যাঠাই মার মতোই মনে হলো তাকে। রাত হতেই তোতা’র মায়ের কথা, বাপজানের কথা মনে পড়ে। চোখ ফেটে কান্নাও আসতে চায়। এই অপরিচিত পরিবেশ হঠাৎ করে অজানা অচেনা লাগে। পরিচিত ঘরে যেতে মন চায়। ও শাশুড়িকে বলে,
-জ্যাঠাই, আমি ঘরে যাবো।
-ওমা, বৌ কী বলে! আর জ্যাঠাই কে গো? মা বলো মা। আর, এখন এটাই তোমার ঘরবাড়ি। চলো, নুরুর ঘরে যাও।
-না মা, আমি তোমার সাথে থাকবো।
-পাগল মেয়ে কী বলে!
-উনারে আমার ভয় করে।

-আইচ্ছা আসো, হেসে বলেন তিনি।
পাশাপাশি শোয় বৌ আর শাশুড়ি। তোতা’র সাথে কথা বলেন তিনি।
-বৌ, তোমার কী ভালো লাগে?
-ঘর, আমাদের ঘর। ঘুম জড়ানো গলায় বলে সে।
-আর?
-খেলতে। আমার অনেক পুতুল খেলতে ভালো লাগে।
-তোমার কী ভালো লাগে জ্যাঠাই, ওহহো, মা?
-আমার মাইয়্যা ভালো লাগে, তোমার মতো ফুটফুটে সুন্দর মাইয়্যা, বৌ।
-তাইলে আমাকে তোতা ডাকো, বৌ কও ক্যান?
-যা তোরে তোতাই ডাকুম। মুহূর্তেই বৌ শাশুড়ির বন্ধুত্ব হয়ে যায়। শাশুড়ি তোতাকে জড়িয়ে ধরে। তোতাও সুযোগ পেয়ে হাত-পা শাশুড়ির গায়ে তুলে দিয়ে আরাম করে ঘুমায়। শাশুড়ির কী ভেবে হঠাৎ চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। হয়তো তার মৃত স্বামীকে মনে পড়েছে, নয়তো মেয়ের অভাব পূরণ হওয়ায় খুশির জল। নাকি ভাবছে, তার শাশুড়িও যদি তাকে তার মতো করে ভালোবাসতো!

কী জানি, তার মনে কী এসেছিলো!
এদিকে নুরুজ্জামান নতুন বৌ ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন দুপুরে নুরুজ্জামান দোকান থেকে ভাত খেতে আসার সময় তোতা’র জন্য ক’টা পুতুল, মাটির খেলনা, ডেকচি পাতিল নিয়ে আসে, মনে হয় মা শিখিয়ে দিয়েছে। তোতা এত্তো খুশি হয়। বাকি দিন তার খেলে পার হয়ে যায়। শাশুড়িও এই পিচ্চি মেয়েকে কী কাজ করতে বলবে! নিজেই মানুষ নিয়ে ধান শুকানো, গোলায় তোলা সব করে।

মাঝে মাঝে তোতা খেলাচ্ছলে বলে,
-আমি ধান কুড়ায় দিই, মা?
শাশুড়ি বলে,
-ইচ্ছে হলে দে। ও কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধান গুছিয়ে দেয়, সামান্য কিছু ধান তার নতুন আনা মাটির ডেকচিতেও রাখে। অন্যরা নতুন বৌয়ের খেলা দেখে হাসে।
কেউ বলে,
-নূরুর মা, বৌকে মাথায় তুলিও না, নামাতে পারবে না।
নুরুজ্জামানের মা হাসে।

আজ রাতে শাশুড়ি মা তোতাকে বলে,
-যা, নুরুর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে আয়।
-আমার ভয় লাগে।
-কীসের ভয়? আমার ছেলে বাঘ না ভালুক, যা বলছি তোতা।
তোতা ভয়ে ভয়ে যায়। বলে,
-মা বলছে, আপনার কিছু লাগবে?
-লাগবে। আগে তুমি বসো।
-আমি মা’র সাথে থাকবো।
-থাকিও। আগে আমার কিছু কথা শোনো, বসো।

তোতা বসে।
-এবার বলো, তোমার ভালো নাম কী?
-কাল শুনছি আনজুমান আরা বেগম। মা আর বাবজান ডাকে তোতা পাখি। বাড়ির সবাই ডাকে তোতা। আপনার মাও তোতা ডাকে।
কথা শুনে নুরুজ্জামান হাসে। বলে,
-তাহলে আমি কী ডাকবো?
-যা ইচ্ছে ডাকেন।
-পাখি ডাকি?
-আচ্ছা৷
-শোনো পাখি, আজ আমার সাথে থাকো। দেখো, আমি মানুষ খারাপ কিনা। খারাপ হলে থেকো না। কাল থেকে মা’র সাথে থেকো।
-আপনাকে ভয় করে।
-কেনো? আমি তো পুতুল এনে দিলাম।
-হুঁ।
-থাকবে?
-মাকে বলে আসি?
-বলতে হবে না। তুমি শুয়ে পড়ো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায় দিই।
-হাত বুলাতে হবে না।
-যাও বুলাবো না। কথা বলতে পারবো?
-আচ্ছা, বলেন।
-পাখি, তুমি ছোটো মেয়ে। তাই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি। বুঝতে পারতেছো?
-হুঁ।
-কিন্তু তোমার চেয়ে বড় কোনো মেয়েও নাই, তোমার বয়স হতেই সবার বিয়ে হয়ে যায়। শুনছো?
-হুঁ।
-তাই আমাকে ভয় পাবার কিছু নাই। আমি তোমার বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। বুঝতে পারছো?
-হুঁ।
-কী বুঝছো?
-ঘুমাইতে দেন।
নুরু এই পিচ্চি মেয়ের কথা শুনে হাসে। কাকে কী বুঝায়! এর বড় হতে অনেক দেরি। এতো ছোট মেয়েকে বাবা-মা কেন যে বিয়ে দেয়!

সারাদিন তোতা খেলে নেচে পার করছে। খেলতে খেলতে ভাবে, শ্বশুর বাড়ি যে খারাপ না, আলমাসকে দেখা হলে অবশ্যই বলতে হবে। ও কেনো যে খারাপ বললো, এতো প্রিয় বান্ধবীকে কেউ মিথ্যা বলে? তোতা’র ইচ্ছে করে এখনই গিয়ে আলমাসকে বলে আসে। সন্ধ্যায় নুরুজ্জামান হাতে করে একটা প্যাকেট এনে তোতাকে না পেয়ে মাকে জিজ্ঞ্যেস করে,
-মা, পাখি কই?
-পাখি কই পামু বাজান?
-তোমাদের বৌ কই?
মা হেসে বলে, ও তোতা? ভাত খায়, খিদে লাগছে বলে৷ ছেলের মুখে ‘পাখি’ ডাক শুনে মা খুশি হয়ে যায়। বৌ তাহলে পছন্দ হয়েছে। বাঁচা গেল, ছেলে ছোট মেয়ে বিয়ে না করার জন্য কত যে বাহানা করছে! বড় মেয়ে কোথায় পাবে সে, আছে নাকি এই মুলুকে? ওর নিজেরই তো ছয় বছরে বিয়ে, কত বার যে বিছানা ভিজিয়ে মাইর খায়ছে। আবার চোখ ভিজে আসে নুরু’র মায়ের।

তোতাকে শাশুড়ি বড় শাড়ী কেটে ছোট করে দিছে পরার জন্য। এখন আর হাঁটতে গেলে হোঁচট খায় না তোতা৷ শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে এসে বলে,
-আমাকে ডাকছেন কেনো?
-এদিকে আসো পাখি।
-বলেন৷
-পাখি, তুমি পড়তে পারো?
-না, পড়ালেখা দিয়ে কী হবে, বিয়ে হয়ে গেছে।
-সেজন্যই তো বেশি দরকার। কিছুই পড়তে লিখতে পারো না?
-আমপারা দুইবার পড়ছি।
-আর?
-আর কিছু না।
-আচ্ছা, শোনো, কাল থেকে আমার মায়ের থেকে কোরান আর নামাজ শিখবে। আর সন্ধ্যায় আমি আসলে বাংলা, অংক, ইংলিশ।
-এত্তো পড়া! আমি পড়বো না। তোতা’র কান্না পায়। সকালেই ভাবছে শ্বশুডর বাড়ি ভালো, এখন দেখে ততটা ভালো না। এরা ওকে মারের ধান্দায় আছে। আলমাস সঠিক বলছে, এরা ব্যথা দিবে।
-কী ভাবছো পাখি? দিনের বেলায় এক ঘন্টা না হয় কম খেলবে। পড়ালেখা শিখলে আমি নতুন খেলনা এনে দিব।
-খেলতেই তো মানা করছেন, আরো খেলনা দিয়ে কী করবো? গাল ফুলিয়ে রাখে তোতা।
নুরুজ্জামান হেসে উঠে।
-কথা তো সত্য বলেছো পাখি। তবে কী জানো, পড়ালেখা অনেক মজার। আমি বিদেশ গেলে চিঠি লিখবে কেমনে, যদি লিখতে না পারো? পড়বেই বা কেমনে?
-পড়তে হবে না। চিঠি দিয়েন না। মক্তবে হুজুর মারতো পড়া না পারলে, আর এখন আপনি মারবেন। তখন শুধু একটা বই পড়ছি। আর এখন এত্তোগুলি, আমি পড়বো না।
-কে বলেছে আমি তোমাকে মারবো? কোনোদিনই মারবো না। পড়বে তো? একদিন পড়েই দেখো আমার কাছে।
-কিন্তু আমার মা যে বলতো, তাড়াতাড়ি আমপারা শেষ কর, বিয়ে হলে পড়া শেষ, বিয়ের পরে পড়া নাই।
-উনি জানতেন না তো তাই।
-কেন জানবে না? মারও তো বিয়ে হয়েছে।
-আচ্ছা যাও, উনি সব জানেন। আসো, আমরা আজ থেকে কিছু পড়ি। এই নাও চক শ্লেট।
তোতা অনিচ্ছাসত্ত্বেও নেয়। তার নিজের সুখের নজর, নিজের কাছেই লাগছে। কিন্তু ও তো জানে, অন্যের নজর লাগে। নিজেরটা কেমনে লাগলো! ভেবে পায় না তোতা।

নুরু শ্লেটে অ লিখে জিজ্ঞেস করে,
-এটা কী বলতো?
-আমি কী জানি?
-মুখে বলো, স্বর অ, এবার লিখার চেষ্টা করো।
-আগে বলেন, আপনাকে চিঠি লিখবো বাংলায় নাকি ইংরেজিতে নাকি আরবীতে?
-বাংলায়।
-তবে অন্যগুলো পড়বো না।
-আচ্ছা যাও, পড়িও না। তবে আরবী পড়তে হবে, নইলে বেহেস্তে যেতে পারবে না।
-বেহেস্ত কি?
নুরুজ্জামান ভাবে, এই অমনোযোগী এবং কথাপটু ছাত্রী পড়াতে অনেক কষ্ট হবে ওর।

নুরুজ্জামান প্রতিদিন কিছু সময় করে তোতাকে পড়াতে থাকে, সাদা কালো ছবিওয়ালা বই নিয়ে আসে তোতা’র জন্য। কখনো ছড়া পড়ে শুনায়, কখনো গল্প। এখন তোতা’র নুরুজ্জামান আর তার পড়ালেখা দু’টোই ভালো লাগে। তোতাকে ক’দিনের জন্য বাপের বাড়ি পাঠায়৷ প্রথমদিন রাতেই বলে,
-মা শ্বশুডর বাড়ি কখন যাবো?
-কেনো?
-এখানে ভালো লাগে না।
-কী বলছিস এসব? নিজের ঘরে ভালো লাগে না!
-মা আমার পড়া আছে।

মা অবাক হয়ে যায়, এই মেয়ে কী বলে। সে নিজেই দুই-তিন বছর পর্যন্ত কাঁদছে না যাবার জন্য। যতবার নাইঅর আসতো, কাঁদতো। ঐদিন আলমাসও কাঁদতে কাঁদতেই গেছে। এরপরও মায়ের খুশি এবং নিশ্চিন্তও লাগে৷ ভালোই হলো, মেয়ে সুখে আছে। মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খুশি হয়ে।

তোতা’র এখন দশ বছর, ও নামাজ পড়া শিখছে, কোরআন খতম কিছু বাকি। বাংলায় পুরা বাক্য লিখতে পারে। ইংলিশে A থেকে Z পর্যন্ত পারে। দশের সাথে পাঁচ যোগ করলে পনের, আর বিয়োগ করলে পাঁচ হয়, তাও জানে। দুই তিন গ্রামে তোতাই শিক্ষিত বৌ এখন। এদিকে নুরুজ্জামানের ইচ্ছে রেংগুন গিয়ে ব্যবসা করার। এখানে ওর কাপড়ের দোকান তেমন চলে না। ও রেংগুন চলে যায়।
তোতা’র খুব মন খারাপ হয়। তবে নুরু তাকে অনেক বই, খাতা কলম কিনে দিয়ে গেছে। পড়া বন্ধ করতে মানা করছে। কোনো মানুষ আসলে চিঠি দিবে কথা দিছে এবং তোতাও যেনো চিঠি দেয়। নুরুজ্জামানেরও ছোট বৌটাকে ফেলে যেতে কষ্ট হচ্ছিলো খুব।

ধীরে ধীরে আরো দু’বছর কাটে। মাত্র তিনটা চিঠি পেয়েছে নুরু থেকে। কী করবে রেংগুন থেকে, কেউ আসলেই না চিঠি পাঠানো যায়। ডাক পোস্টে দিলে নাও পেতে পারে, পোস্ট অফিস নাই।

তোতা এখন আর আট বছরের ছোট্টটি নাই। বার বছরের তোতা, তাল গাছের মতো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। একদিন ওর পা বেয়ে রক্ত পড়তে দেখে ভয় পেয়ে শাশুড়ির কাছে দৌড়ে যায়।
-মা, আমার পা কেটে রক্ত ঝরছে।
-কোথায় কাটলি?
-জানি না।
-ব্যথা নাই?
-না।
-দুরু পাগলী, তুই বড় হয়ে গেছস, খুশির খবর। শাশুড়ি তোতাকে জড়িয়ে ধরে।
মিষ্টিসহ তোতা’র বাপের বাড়ি তোতা’র বড় হবার খবর পৌঁছায় দেন তিনি।
ওনারাও নতুন জামা কাপড়, মিষ্টি নিয়ে মেয়েকে দেখতে আসেন।

তারও একবছর পর নুরুজ্জামান দেশে আসে। এসে তোতাকে পাখি বলে ডাকলে সে লজ্জায় কাছে আসতে পারে না। তিন বছরে সে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে৷ আসলেও তাই। রাতে মা তোতাকে নতুন বৌয়ের মতো সাজিয়ে দেয়। লজ্জাবনত তোতা ঘোমটা দিয়ে বসে থাকে, বিছানার উপর। এখন সে আট বছরের বালিকা নয়, যার নুরুজ্জামানকে ভয় লাগতো। এখন সে বিয়ে কী বুঝতে পারা লাজুক কিশোরী। এই প্রথম নুরুজ্জামানেরও এই মেয়ের প্রতি গভীর প্রেম জাগে। সে ঘোমটা তুলে তার সুন্দরী পাখির দিকে অপলক চেয়ে থাকে।

নুরুজ্জামান খেয়াল করে, তোতা আর আগের মতো ছটফটে নেই। চুপচাপ লাজুক থাকে বেশি। ওর হঠাৎ করে কথা বলা আগের পাখিকে ফিরে পেতে ইচ্ছে করে৷ নুরুজ্জামান চেষ্টা করে তোতাকে আবার স্বাভাবিক করতে। এতো দিনের গ্যাপ মেটাতে তোতা’র সময় লাগে। তাছাড়া তোতা এখন বড় হয়েছে না! আগের নুরুজ্জামান তো কখনো ছুঁয়েও দেখেনি, স্বামী মনে হতো না, ওকে ছোট মেয়ে ভাবতো। আর এ যে তার স্বামী, তাদের স্বামী স্ত্রী’র মধ্যেকার সম্পর্ক যে হয়ে গেছে। কীভাবে আগের মতো বকবক করবে! উনিই বা কী মনে করবেন! যদিও তোতা’র সারাক্ষণ নুরু’র পাশেই থাকতে ইচ্ছে করে৷ দু’জন একে অপরের সান্নিধ্য পাবার তীব্র আকাঙ্খায় অপেক্ষা করে। শেষে নুরুজ্জামান গল্পের বই এনে তোতাকে ডাকে।
-পাখি, শোন৷ তোমার জন্য বই এনেছি।
-আচ্ছা।
-আচ্ছা কী? কাছে আসো, তোমাকে গল্পটা পড়ে শুনাই।
-আমার লজ্জা লাগে।
-আমাকে লজ্জা কী? আমাকে তো পাঁচ বছর থেকে চেনো। চেনো না?
-হুঁম। মানুষ কী বলবে?
-হায় আল্লাহ, মানুষ আবার কী বলবে? ঘরে তো আমরা তিনজন। আমি আবার চলে গেলে তোমার খারাপ লাগবে না?
-হুঁম।
-তুমি আমার পাশে আসো তো।
তোতা পাশে যায়। নুরুজ্জামান ওর একটা হাত ধরে রাখে, যাতে পালাতে না পারে।
-আমাকে তোমার ভালো লাগে না পাখি?
-হুঁম।
-কী হুঁম? লাগে না!
-আমি বলতে পারবো না।
-তাইলে ঠিক আছে। আমি কালকেই চলে যাই।
-না না, যাইয়েন না। আমার খুব একা লাগবে।
নুরুজ্জামান হাসে।
-তাহলে আমাকে ভালো লাগে?
তোতা নুরু’র মুঠো থেকে হাত টেনে নিয়ে দু’হাতে মুখ লুকায়। মিটিমিটি হাসে। উত্তর দেয় না। আর নুরু’র উত্তরটা শুনতে মন চায়। এই কিশোরীর মন পাওয়া যেন সাত জন্মের তপস্যা।

আস্তে আস্তে তোতা নুরু’র পাশ ঘেঁষে থাকা শুরু করছে। যেখানে নুরু, ঘরের সামনে পেছনে, তোতাও আশে পাশে থাকে। দূরের মাঠে মেলা হয় এক জোৎস্না রাতে। নুরু মাকে বলে নিয়ে যায় তোতাকে বোরকা পরিয়ে। সারা পথ হেঁটে যায় দু’জন দু’জনের হাত ধরে। কখনো নুরু তোতাকে জড়িয়েও ধরে। তোতা’র এতো ভালো লাগে। এক সীমাহীন ভালো লাগায় বুঁদ হয়ে থাকে দু’জন। হঠাৎ তোতা বলে, মেলায় এতো মানুষের ভেতর না গেলে হয় না?
-আমি যে তোমাকে দেখাবার জন্যই এনেছি। যেতে চাও না?
-না।
-ঘরে যেতে চাও?
-না। এম্নি হাঁটি?
-ঠিক আছে। এম্নিই হাঁটি। নুরুজ্জামানেরও ভালো লাগে, তার এই প্রস্তাব। ওর এমনিতেই গ্যাঞ্জাম ভালো লাগে না। তোতাকে কিছুক্ষণ একা করে পাবার জন্য, বাইরে ঘুরতে, তোতাকে খুশি করতেই নিয়ে আসছে। থাক, তোতা যাতে খুশি হয়।

ওরা দু’জন অনেকক্ষণ হেঁটে ঘরে আসে। আস্তে করে ঠেলা দিতেই দরজা খুলে যায়। শাশুড়ি ঘুম। ক্লান্ত দু’জন জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে শাশুড়ি জিজ্ঞেস করে, কী কিনলিরে তোতা?
-কিছুই কিনিনি মা। মেলায় কিছু নাই।
-ও আচ্ছা, বলে একটু মুচকি হাসেন। তোতা’র মনে হয় উনি চুরি ধরে ফেলেছেন।

নুরুজ্জামান এসেছে প্রায় মাস পেরোয়। আরও এক মাস থাকবে। এদিকে হঠাৎ করে তোতা’র কিছু ভালো লাগে না, খাইতে মন চায় না। রাতে নুরু’র জড়িয়ে ধরাতেও খারাপ লাগে, বমি আসে। মাঝে মাঝে নুরুকে বলে আমাকে আজ ধরবেন না, রাগ করবেন না আবার, বমি আসে। নুরু বলে,
-শরীর খারাপ, দাঁড়াও কাল সদরে গিয়ে ডাক্তারকে বলে ওষুধ এনে দেব।
-জানি না, কেমন কেমন লাগে, কিচ্ছু ভালো লাগে না৷
নুরু’র সন্দেহ লাগে। নতুন মেহমান আসবে না তো!
-মা জানে তোমার বমি হচ্ছে?
-না, বমি শুধু আজ একবার করছি। মা পুকুরে ছিল।
-আমার মনে হয় আমাদের ঘরে মেহমান আসবে।
-কে আসবে?
-তুমিই বলো, কে আসবে?
-আমি কিভাবে বলবো?
-বারে, তোমার পেটে বাচ্চা আর তুমিই জানো না!
-কী!!!! খুশিতে ভয়ে চিল্লায় উঠে তোতা।

-আস্তে, মা জেগে যাবে। আমার তাই মনে হয়।
-আমার ভয় লাগে, খুব ভয় লাগছে, বলে তোতা কেঁদে দেয়।
নুরুজ্জামান ওকে জড়িয়ে ধরে সাহস দেয়।
-দূর পাগলী, আমি হয়েছি না আমার মায়ের পেটে, তুমি হয়ছো না? আল্লাহ সব ভালোভাবে করে দিবে। আর এখন কাঁদার কিছু নাই। আমি তো এমনি বললাম। নাও হতে পারে। হলে তুমি খুশি না?
-হ্যাঁ বলে তোতা ওর তলপেটে হাত দেয়। বাচ্চা কি এখানে থাকে? জিজ্ঞেস করে নুরুকে।
-হ্যাঁ, আমি একটু দেখি? হাত দিই?
-না। ও ব্যাথা পাবে। তোমার হাত শক্ত।
-আহারে, বলে নুরুজ্জামান তোতাকে আদর করতে থাকে। নুরুজ্জামান খুব খুশি। কিন্তু একটু দু:শ্চিন্তাও হয়। তোতা মা হবার জন্য বেশি ছোট নয় কি?

পরদিন ভোরে সবার আগে নুরু উঠে কল চেপে তোতাকে গোসল করায়। পুকুরে যেতে দেয় না। যদি কোনো বিপদ হয়! তোতা’র ভাগের সব কাজ আগ বাড়িয়ে করতে গেলে মা বলে, কিরে ঘরের কাজে তুই হাত দিস কেন?
-সময় কাটে না মা তাই। ঐ সময় তোতা দৌড়ে ওয়াক ওয়াক করে ঘরেই বমি করে দেয়। মায়ের আর বুঝতে বাকি থাকে না, ছেলের কাজ করার রহস্য। আবার তোতা’র ঘরে সুসংবাদ যায়, সাথে মিষ্টি। তোতা’র মা বাপও আসে অনেক কিছু নিয়ে। মেয়েকে দোয়া করে দিয়ে যায়।

নুরুজ্জামান আর তার মা তোতা’র অনেক যত্ন নেয়৷ একমাত্র ছেলের ঘরে সন্তান আসবে। খুশি আর ধরে না। এদিকে নুরু’র যাবার সময় হয়ে আসে। নুরু’র যেতে মন চায় না, তোতা’রও বিদায় দিতে ইচ্ছে করে না। যাবার দিনের আগের রাতে তোতা এই প্রথমবার নুরুজ্জামানকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদে। নুরুজ্জামানও তোতা’র সাথে ছোটো হয়ে যায়। তার চোখ দিয়েও অনবরত পানি ঝরে। বিদায় সহ্য করতে না পারা দুই প্রেমিক-প্রেমিকা যেন তারা।

নুরুজ্জামান বলে, আমাদের বাচ্চার খেয়াল রাখবে তো ভালোভাবে? অনেক আদর করিও, আমার ভাগেরটাও। একদম মারবে না। মানুষ পেলে আমি চালানী (উপহার) পাঠায় দিবো, তোমার আর বাচ্চার। এসব শুনে তোতা’র কান্না আরো বেড়ে যায়।
-কেমনে থাকবো আমি আপনাকে ছেড়ে?
-তোমার তো মা থাকবে, বাচ্চা থাকবে, আর আমি তো খালি একা। বলো, কার বেশি কষ্ট?
-আপনার।
-হুম। তবে ভেবো না, আমি এবার তাড়াতাড়ি আসবো।

পরদিন দুপুরে খেয়ে নুরুজ্জামান আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বৌ আর শাশুড়ি বিদায় দিয়ে পুকুরে নামে ওযু করতে, দু’রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করবে তারা। কিন্তু হঠাৎ করেই তোতা মাথা ঘুরে পড়ে যায় ঘাটে। রক্তের বন্যা বয়ে যায় পুরা ঘাটে। শাশুড়ি ‘আল্লাহ গো’ বলে চিৎকার দিলে গ্রামসুদ্ধ সবাই ভেঙে আসে। ধরাধরি করে তোতাকে এনে ঘরে শুইয়ে দেয়। অনেকক্ষণ পর তোতা’র হুঁশ আসে, কিন্তু তার পেটে তখন আর বাচ্চাটা নাই।
এটা শুনে, ও আল্লাহ গো, আমি তাকে কী জবাব দেবো বলে সে আবার মূর্ছা যায়।

এদিকে নুরুজ্জামান যাবার কষ্টে দুঃখী হলেও অনাগত বাচ্চার কারণে তার মনে কিছু সুখও আছে। সে আগামী এক বছরেও জানতে পারে না বাচ্চাটা ঐদিনই চলে গেছে। একজন মানুষ পেলে সে খুঁজে খুঁজে এক বছর বয়সী ছেলের জামা কিনে লাল নীল রঙ্গীন দেখে, যাতে মেয়ে হলেও পরতে পারে। মেয়ের জামা দিলে তো আর ছেলে পরতে পারবে না, এতোটুকু জ্ঞান তো তার আছেই।
ও হিসাব করে দেখে, বাচ্চা তখন পাঁচ কী ছয় মাসের হয়েছে। অনেক জিনিসের সাথে একটা সুন্দর চিঠিও দেয়, তাতে সব বাচ্চার কথা। ও এখন কি করে? ছেলে না মেয়ে? বসতে পারে? তোমাকে চেনে? কাঁদে বেশি, নাকি হাসে? নাম কী রাখছো? আমি আসলে আমার কোলে কি আসবে? ইত্যাদি। চিঠি পেয়ে তোতা একেবারে ভেঙে পড়ে। কী বলবে সে, কী লিখবে? কাপড়গুলো বুকে বেঁধে কাঁদতে থাকে, সাথে নুরুর মাও কাঁদে।

[আমার নানীর নাকি আট বছর বয়সে বিয়ে হয় এবং তিনি অনেকদিন পুতুল দিয়েও খেলেছেন শুনেছিলাম, তা থেকে বাকিটা কল্পনা করা]

শেয়ার করুন: