শেখ তাসলিমা মুন:
বয়ো:সন্ধিক্ষণ থেকে শুরু করে ৭০ বছর পর্যন্ত একজন পুরুষ বা নারী যৌন অনুভব করে থাকেন, এটি একটি সাধারণ প্রসেস। শারীরিক, মানসিক অনেক কারণে এর হেরফের হতে পারে। বয়সের সাথে কিছু পার্থক্য হয়। বয়স বেশি হবার সাথে কিছু পার্থক্য দেখা গেলেও পরিসংখ্যান বলে নারী-পুরুষ ৭০ বছর পর্যন্ত যৌন অনুভবে সক্ষম থাকেন।
আমার আলোচনার বিষয় সেটি নয় আমার বিষয়, এই যৌন অনুভবকে জানতে, বুঝতে, শিখতে এবং তাকে সুস্থভাবে প্র্যাকটিস করার বিষয়ে মানুষের ব্যর্থতা এবং তার কারণ।
সেদিন একটি নিউজ লিঙ্কে দেখছিলাম, একজন মাদ্রাসার শিক্ষক তার আড়াইশো ছাত্রকে দীর্ঘদিন ধরে বলাৎকারে লিপ্ত ছিল গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত।
ইসলাম মনে হয় সবচাইতে বেশি কাম নিয়ে ধর্ম গ্রন্থগুলো ভারি করে রেখেছে। মানবজাতির একাংশ নারী সমাজকে কাপড়ে মুড়িয়ে রেখেছে এই একটি গ্রাউন্ডে। তবু ইসলাম অধ্যুষিত এলাকায় সেক্সুয়াল অপরাধ কমেনি, সেটি নিয়ে কেউ জোরালো কথা তোলে না। বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত। ধর্মের এতো বিধিনিষেধ মাদ্রাসার শিক্ষককে শিশু বলাৎকার থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এমনকি তার ধর্মের বিশ্বাস ও কমিটমেন্ট সত্ত্বেও। তাহলে সমস্যাটির সমাধান ধর্ম করতে পারেনি, সমাধানটি আমাদের অন্য জায়গায় খুঁজতে হবে।
আদিম যুগে সেক্সুয়াল অপরাধ ছিল না। তারা এটিকে অপরাধ করে তোলেনি সেজন্য। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশ, সমাজ ও পরিবারের চিন্তার উন্মেষের সাথে যৌনতা বিষয়ে নিয়মের প্রবর্তন হয়। ক্রমশ তারা বুঝতে পারে, ক্রমবর্ধমান মানব সমাজে এ নিয়ন্ত্রন দরকারি নতুবা এটি সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। তারা সেক্সুয়াল বিহ্যাভিয়ারকে নিয়ন্ত্রণে ধর্মকে সবচাইতে কার্যকরি মাধ্যম হিসেবে মনে করে। পাপ ও তার শাস্তি এবং ঈশ্বর রাগান্বিত হবেন এ ভয় মানুষের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে সেক্সকে নিয়ন্ত্রন করার পদ্ধতিই অনেক বছর পর্যন্ত চলে আসছে। এ সময় অব্ধি। কিন্তু বিপর্যয় বারবার বলে দিচ্ছে সময়টি আজ শেষ হয়ে এসেছে। ঈশ্বর রাগান্বিত হবেন, পরকালে শাস্তি অপেক্ষা করছে এ ভয় থাকা সত্ত্বেও ধর্মীয় অঙ্গনেই এ অপরাধ প্রকট হয়ে উঠছে।
মানুষকে নিষিদ্ধতা নয়, পাপের ভয় নয়, পরকাল এবং আল্লাহর শাস্তির ভয় দেখিয়ে নয়, ভিন্ন উপায়ে এ অপরাধ কমিয়ে আনতে হবে।
বিগত চল্লিশ বছরে আমাদের অঞ্চলের মানুষের সংখ্যা যত বেড়েছে, সে হারে ধর্মীয় র্যাডিকেলাইজেশনও বেড়েছে। অশিক্ষা, মাদ্রাস শিক্ষা এবং কট্টরপন্থীরা সমাজটি দখল করে নিয়েছে, সেটি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। স্বাধীনতার পরপরই বিভিন্ন দফায় সামরিক শাসন এবং পরে গণতন্ত্রের নামে দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়নকে জিইয়ে রাখতে দেশে আদর্শের ধ্বস নেমেছে। আর তার ফোঁকর দিয়ে দেশ একটি মৌলবাদের জন্তুতে পরিণত হয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী উগ্রপন্থী মিলিট্যান্ট গ্রুপের সংগঠিত হয়ে ওঠা। এ সংগঠনগুলো দরিদ্র এবং উন্নত দেশে মাইগ্রেটেড হওয়া ডিস্ক্রিমিনেটেড মাইনরিটিজ মুসলিম তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে ধর্মের নামে। ধর্মীয় আদর্শের নামে। পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাদের একত্রিত করা সহজ হয়ে উঠেছে। যার বাতাস বাংলাদেশেও কম করে পড়েনি।
আড়াই হাজার বছর পূর্বের শিক্ষাভিত্তিক মাদ্রাসাগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। এর প্রভাব শিক্ষা এবং সামাজিক জীবনে অভিনবভাবে বিস্তার করেছে। এমনকি ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে যে প্রাইভেট শিক্ষালয়গুলো ধনী সমাজের জন্য গড়ে উঠেছে, সেখানেও এই ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের টোটাল কন্ট্রোল স্থাপিত হয়েছে। সমাজে, প্রশাসনে, শিক্ষাঙ্গনে খুব সন্তর্পণে এরা কাজ করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানমনস্কতা এখন শূন্য কোঠায় নেমে গেছে। সাহিত্য, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যার জায়গায় একরৈখিক ধর্মীও শিক্ষা বা শিক্ষার বিপরীতে অশিক্ষা বিরাটভাবে স্থান দখল করে নিয়েছে।
শিক্ষাকে মুক্ত করা জরুরি। বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমাদের ছেলেবেলায় খুব মনে পড়ে আমরা বন্ধুরা স্কুলের বাইরে বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনা করতাম। মানুষের মহাশূন্য আবিষ্কার নিয়ে কথা বলতাম। মেডিসিনের সফলতা নিয়ে কথা বলতাম। বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা যখন করতাম, তখন ছোটরা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকতো। বড়রাও। এভাবে বৈজ্ঞানিক আলোচনা ছড়িয়ে যেতো। মানুষের ভেতর ছড়িয়ে যেতো। এখন সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা চলছে। ভিন্ন এক অন্ধকার ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেকটি ছেলেমেয়েকে তাদের শরীর এবং তার ফাংশন বিষয়ে অবহিত করা মাধ্যমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। গ্রামে গ্রামে হেলথ কমপ্লেক্সের মাধ্যমে ট্যাবু ভেঙে সাধারণের জন্য যৌন জীবন বিষয়ে সরল তথ্য সরবরাহ করলে এ বিষয়টি উন্মুক্ত হয়ে উঠতে বাধ্য। মানুষ যত এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করবে, তত এ বিষয়গুলো জীবনের সরল অংশ হয়ে উঠবে। এ বিষয়টি যেমন অবদমনের প্রয়োজন হবে না, তেমনিভাবে কোন পাপ বিষয় হয়ে উঠবে না।
নিষিদ্ধতা এবং অবদমনে মানুষ যে পরিমাণ ব্যর্থ হয়ে উঠে তার জের ধরেই অপরাধগুলো সংগঠিত হয়। যৌন সন্ত্রাস, অপরাধ বেড়ে চলে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গনে, ধর্মীয় শিক্ষালয়ে, কর্মক্ষেত্রে, এক কথায় সর্বত্র। আর এ অপরাধের শিকার হয় নারী এবং শিশু। শিশুদের ক্ষেত্রে কন্যা শিশুদের মত পুত্র সন্তানেরাও।
যৌন শিক্ষা এবং তথ্যকে মুক্ত করতে হবে। মানুষকে বিজ্ঞান ভিত্তিতে যৌন জীবন পরিচালিত করতে প্রশিক্ষিত করতে হবে। নিষিদ্ধতা ও অবদমন নয়, প্রতিটি বয়সে মানুষকে এ বিষয় সম্পর্কে জানতে দিতে হবে। পাপ ভয়ে আক্রান্ত না করে একজন কিশোর থেকে শুরু করে প্রবীন পুরুষকে যৌনতা এবং তার দায় বিষয়ে মুক্ত শিক্ষা দেওয়া খুব দরকারি।
দায়িত্ববোধ শিক্ষারই একটি কার্যকর প্রভাব। ধর্ম যত পাপাবিদ্ধ করে দোজখের ভয় দেখাবে তত সে নিজে পাপচারে লিপ্ত হবে। সে যত তথ্য সমৃদ্ধ হবে তত সে আত্মনিয়ন্ত্রক হবে। সে নিজেকে সাহায্য করবে। অন্যকে সাহায্য করতে সহায়তা করবে। চারপাশে একটি স্বাস্থ্যকর জীবন গড়ে উঠবে। নারী ও শিশুরা নিরাপদ হবে।