উন্নয়নশীল দেশে রোবট দিয়ে খাবার পরিবেশন, কতোটা যৌক্তিক?

সুরমা রহমান:

কয়েকদিন আগে পরিচিত একজনের সাথে কথা হচ্ছিল, কথা প্রসংগে সে রোবট “সোফিয়া” র আগমনী বার্তা দিচ্ছিল আমাকে বেশ উচ্ছাস কন্ঠে। ঢাকার আসাদ গেটের পাশে মিরপুর সড়কের নাকি একটি রেস্তোরাঁয় অলরেডি খাবার পরিবেশনকারী হিসেবে রোবট দায়িত্বও পালন করতে শুরু করেছে। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বেশ আলোড়িত।

কিন্তু এতে উচ্ছাসের কিছু দেখছি না আমি। যে দেশের লাখো লাখো শিক্ষিত/অশিক্ষিত যুবক কাজের খুঁজে রাস্তায় হাটতে হাঁটতে পায়ের জুতা ছিঁড়ছে, যে দেশে লাখো লাখো মানুষ কাজ না পেয়ে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে এবং কিছুদিন পর কেউ ফিরছে লাশ হয়ে, কেউ শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়ে। আর এদের মাঝেই কিছু হতভাগা পড়ে আছে সেখানে শুধু নিজের শ্বাসটুকু নিতে। যাকে বলে বেঁচে থেকেও মৃত। মাস শেষে তাদের পকেটে টাকা থাক না থাক, তাদের পাতে ভাত থাক না থাক, পরিবারের খরচের পয়সাটা পাঠাতে ভুল করে না।

আমারই পরিচিত একজন শ্রমিক হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় ১০/১২ বছর আগে। আমার জানা মতে পরিবারের কোন দায়িত্ব পালনেই তার কোনো অবহেলা ছিল না। মাটির ঘরকে দালানে রুপান্তরিত করা এবং বউ বাচ্চাসহ পরিবারের সব সদস্যদের বায়না মেটাতে মেটাতে একদিন সে নিজেই নিয়তির বায়না হয়ে গেল। বেশ কয়েকদিন পর তার লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা হলো, সেই সাথে তার জিনিসপত্র পাঠাবে, তাই কয়েকজন গেল তার আবাস স্থলে। গিয়ে দেখে কয়েকটা পুরাতন জামাকাপড় ছাড়া দেয়ার মতো আর কিছুই ছিল না। এরকম লাখো যুবকের লুকানো গল্প আছে, যা হয়তো কেউ জানে না।

রোবট দ্বারা খাবার পরিবেশন করার ঘটনা কোনো নতুন মাইলফলক নয়। নতুন মাইলফলক হতো তখনই, যখন বেকার যুবকদের চাকরির সুযোগ করে দিয়ে তাদের উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে সুযোগ্য কর্মী করে গড়ে তুলতো। রেস্টুরেন্ট মালিকরা যদি তাদের Business policy অত্যাধুনিক করতে চান, ব্যবসায় আধুনিকতা আনতে চান, তবে কি শুধু রোবট দিয়ে খাবার পরিবেশনাতেই আধুনিকতা কিংবা নতুনত্ব! না। আমাদের দেশের মানুষ সবসময়ই উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করে থাকে। আর সেসব জায়গায়ই তারা যেতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে, যেখানে পশ্চিমা ছোঁয়া আছে।

লন্ডনে গত কয়েকদিন আগে দেখলাম বেশ কয়েকটা MacDonald (রেস্টুরেন্ট) সাময়িকভাবে বন্ধ, কারণ ওরা কাজ করছে Innovation আনার জন্য। কয়েকদিন পরই দেখলাম কাজ শেষ। ভিতরে গেলাম আমরা, যাওয়ার পর তো ওদের Innovation system দেখে আমি অবাক, আর সে সাথে খুশিও এই ভেবে যে এখন আমার ছেলে Restaurant এ এসেও খেলার সুযোগ পাবে তাইলে! না ওদের নতুনত্বের List এ কোনো “সোফিয়া” যোগ হয়নি। স্টাফ আগের সমানই আছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিও হচ্ছে। যা নতুন যোগ হইছে তা হলো Self Order System (Online এ Order করে Receipt নিয়ে Queue তে গিয়ে দাঁড়ালেই খাবার পাওয়া যাবে, কিছু কিছু জায়গায় আগেও ছিল, যে ব্রাঞ্চগুলোতে আগে ছিল না, সেগুলোতে নতুন যোগ করে নিচ্ছে) আর বাচ্চাদের খেলার জন্য কিছু উপকরণ। এতে স্বভাবতই বাবা মায়েরা বাচ্চা নিয়ে অন্য Restaurant বাদ দিয়ে McDonald এ যাবে এবং সেটা হচ্ছেও। একে বলে Innovation এবং Business policy. বাচ্চারাও আনন্দ পেল, বাবা মাও রিলাক্স এ খাবার খেল, “সোফিয়া” রও ওড়না বাঁচলো।

সোফিয়ার হাত ধরে বাংলাদেশের নতুন শিল্প যুগে প্রবেশ না ঘটিয়ে কি আমরা আমাদের বেকার যুবকদের হাতে ধরে তাদের পরিবারে যোগ হওয়া হতাশাগুলোকে বিয়োগ করতে পারি না?

প্রযুক্তি আমাদের জীবন-জীবিকাকে সহজ করে দিয়েছে বিভিন্নভাবে। বৈশ্বিক পুঁজিতন্ত্রের অবিশ্বাস্য বিকাশ ঘটছে প্রযুক্তির সমকালীন বিকাশের ওপর ভর করে। তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রতিটা জিনিসেরই ভালো খারাপ দুইটা দিক আছে। আর আমরা বরাবরই মনে হয় ভালো দিকটাকে উপেক্ষা করেই চলি। যেখানে উন্নত বিশ্বে প্রযুক্তি সন্তান ও বাবা-মাকে রিলাক্স দিচ্ছে, আনন্দ দিচ্ছে, সেখানে সেই সমান প্রযুক্তি আমাদের যুবসমাজের হতাশার কারণ হচ্ছে না তো! কিংবা তাদের বেকারত্ব বাড়ানোর পিছনে কোনো আবদান রাখবে না তো! আমাদের “সোফিয়া” ব্যবহারের খেসারত পরবর্তীকালে ব্যাপকভাবে দিতে হবে না তো! সেটাই দেখার বিষয়, এখন তো কেবল অপেক্ষার পালা।

Surma Rahman
Teacher, London, UK

শেয়ার করুন: