ধর্মের দোহাই দিয়ে গড়ে উঠা পুরুষতন্ত্রের থাবা

আফরোজা চৈতী:

নারীর প্রতি সহিংসতার একটি বড় কারণ হলো নারীর প্রতি অবদমনমূলক মনোভাব। সেটা শুরুই হয় পারিবারিক কাঠামো থেকে। তারপর একে একে রাষ্ট্র, ধর্ম, সামাজিক ট্যাবু তাকে দেয় প্রচ্ছন্ন ছায়া। সেই ছায়ার তলে পুরুষতন্ত্র চর্চা করে তার হাজার বছরের অভ্যস্ততা, অভ্যাস, দৃষ্টিভঙ্গি। হাজার বছর ধরে যে রাজনীতি নারীর সাথে করা হয়েছে সেটা থেকে বের হয়ে আসা এতো সহজ নয়।

পুরো সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, রাষ্ট্র কোথাও নারীপুরুষের সমতা নিশ্চিত করা হয় নাই। কাজেই সেই প্রথার শেকল ভাঙার কাজ এতোটা সহজ কখনই ছিলো না। প্রথার বাইরে গিয়ে প্রথা বদলানো যায় না, বরং প্রথার ভিতরে থেকেই লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়।

প্রাচীনকালে যখন আর্য-অনার্য ছুত-অচ্ছুত নিয়ে অনেক টানাপোড়েন ছিলো, সেখানে অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুসরণে নিজেদের লালসা চরিতার্থ করার নিমিত্তে পুরোহিতগণ আয়োজন করতেন কুমারী যজ্ঞের, যেখানে ছয় থেকে দশ বছরের কন্যা সন্তানদের কোনও গোষ্ঠী বা ব্যক্তির পাপ কাটানোর নিমিত্তে পাঠানো হতো ধর্মগুরু নামধারী এইসব নরপশুদের যজ্ঞের আধার হিসেবে। আজ থেকে কতশত বছর আগেই ধর্মের নামে জায়েজ করা হয়েছিলো এই গণধর্ষণ!
ক্ষত-বিক্ষত বিকৃত ধর্ষণের শিকার সেই হতভাগ্য শিশুকন্যাদের চোখের জলে বাবা-মা দাহ করতেন! এই বিষয়টির উপর কিছু নমুনা পাবেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অন্তর মহল’ ছবিতে। যেখানে সেই রাজ্যর পাটরানীকে পাঠানো হয় পাঁচ পুরোহিতকে তুষ্ট করতে।

অবস্থা কি খুব বেশি পাল্টেছে? নারী কি এখনও রাজ্যের নামীদামী সমাজসেবীদের সেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে না? নারীর প্রতি সহিংসতা আজ নতুন কোনও ঘটনা নয়, বরং যুগে যুগে কালে কালে রাষ্ট্র সমাজ ধর্ম জায়েজ করেছে নারীর প্রতি সহিংস আচরণকে। কৌলিণ্য প্রথার যুগে নয় বছরের শিশুকন্যাকে বিয়ে দেয়া হতো ষাট বছরের কুলীন ব্রাহ্মণের সাথে। কেন? এতে আগামী সাত জন্ম ঐ পরিবার এর মোক্ষলাভ কেউ ঠেকাতে পারবে না, এটাই ছিল ধারণা। নয় বছর বয়সে সে মেয়েটি বিধবা হতো, আর বিধবা নিয়ম অনুযায়ী তার সারাজীবন অপুষ্টি অনাহারে কাটিয়ে দিতে হতো পুরো জীবন।জন্মের পর শৈশব না যেতেই তাকে পরতে হতো বাধ্যতামূলক বার্ধক্যের বেশ! অপরদিকে পুরুষ? তারা তাদের ধর্মের নিয়ম মেনে কখনও চারটি, কখনও একশটি বিয়ের নিয়ম মেনেছেন।

ধর্ম কি তাই বলে? না, প্রকৃত ধর্ম কখনই বহুবিবাহকে উদ্বুদ্ধ করে নাই, ধর্ম কখনই যজ্ঞের নামে গণধর্ষণকে উদ্বুদ্ধ করে নাই, ধর্ম কখনই বৌ পেটানো জায়েজ করে নাই, ধর্ম কখনই পুরুষের লালসা মেটানোর জন্য নারী শরীরকে পণ্য করে নাই। এই ধর্মকে পুরুষতন্ত্র তার নোংরামি চরিতার্থ করার নিমিত্তে হাজার বছর ধরে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত করেছে।কিন্তু এই আধুনিক যুগেও তো যজ্ঞের বলি হচ্ছে নারী। এই মনোভাব থেকে বের হতে পারছেন না অনেক শিক্ষিত নারীও। কর্পোরেট দুনিয়া আজ মেতেছে এই নারীদেহের বিকিকিনিতে! নারীর মেধা আর যোগ্যতার চেয়েও বেশি বিবেচিত হচ্ছে তার দৈহিক সৌন্দর্য আর আবেদনকে। কত নারী ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে এই লালসার বলি হন এখনও! অবস্থা কি পাল্টেছে সেই শুদ্র নারীর?
নাঃ! পাল্টায়নি কিছুই!!

সময় আর যুগের মোড়কে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বারংবার। তাই মাদ্রাসায় পড়তে যাওয়া ছয় বছরের কন্যাশিশু অথবা ইফতার নিতে যাওয়া তিন বছরের শিশুকন্যার নিস্তার মেলে না এই হায়েনারুপী পুরুষগুলোর কাছ থেকে। ধর্মের মোড়কে, রাষ্ট্রের আইনের ছায়ায়, সামাজিক ট্যাবুর আদলে, কর্পোরেটজিমের কোলে, পুরুষতন্ত্রবাদ কালে কালে যুগে যুগে প্রশ্রয় আশ্রয় প্রণোদনা পেয়ে এসেছে। আর যখনই সে তার স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে দেখেছে নারীর মেধার কাছে, সক্ষমতার কাছে, তখনই চার হাত-পায়ে কিলবিল করে সে তুলে ধরেছে পুরুষতন্ত্রের ফণা!

নিজের নষ্ট লালসাকে চরিতার্থ করেছে শিশ্ন সর্বস্ব মানসিকতায়, বাছবিচার করেনি মানবিকতার বোধ দিয়ে, একবারও ভাবেনি ধর্ম তাকে উপাধি দিয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত! সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে!! আর এই সবের ইন্ধন সে পেয়েছে তার যাপিত জীবন থেকে, এই পরিবার রাষ্ট্র ধর্ম ও সমাজের প্রচ্ছন্ন ছায়ায়। যেখান থেকে সে শেখে নারী মানেই দাসী, নারী মানেই অধঃস্তন, নারী মানেই ভোগ্যপণ্য।

শেয়ার করুন: