সাদিয়া সুলতানা:
সকাল সাড়ে নয়টায় লিমা কোর্টের বারান্দায় এসেছে। দুইজন পুলিশ লিমার কাকা আফসারের বাসায় গিয়ে লিমা আর ওর বাবা জয়নালকে এখানে নিয়ে এসেছে। আগের দিনই থানা থেকে পুলিশ গিয়ে ওদের বাড়িতে খবর দিয়ে এসেছিল। পুলিশ দেখার পর থেকে জয়নাল মিয়ার গত কয়দিনের অস্থিরতার সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভয়। মেয়েকে নিয়ে কোর্টে জবানবন্দি করাতে হবে!
কোর্টে গেলে কী হবে? কী হয়? কী এক অচেনা দুর্ভাবনায় জয়নাল মিয়া সারা রাত বিছানায় ছটফট করেছে। বহু আরাধ্য ধানের শীষের আগমনের সাথে বৈশাখের ঝড়ো বাতাসের আচমকা উপস্থিতিতে যেমন সুখ-দুঃখ একাকার হয়ে যায়, জয়নালের সব অনুভূতি তেমনি একাকার হয়ে গেছে। আরও একটা নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি জানাতে জানাতে জয়নাল মিয়া লিমার হাত ধরে কোর্টের বারান্দায় এসেছে।
সদর থেকে জয়নাল মিয়ার বাড়ি প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর। লিমার গ্রামের নাম মৌহার, থানা রায়গঞ্জ। রায়গঞ্জ থেকে সদরে পৌঁছাতে লোকাল বাসে আধা ঘন্টার মতো লাগে। আর কোর্ট কাচারির সময় হলে তো কথাই নেই। বাসে জায়গা পাওয়াই মুশকিল। সময়মতো গন্তব্যে পেীঁছাতে না পারার চিন্তা থেকে লিমা আর জয়নাল মিয়া গতকাল বিকালেই পুলিশের কথামতো সদরে চলে এসেছে। সদরে জয়নাল মিয়ার জ্যাঠাতো ভাই আফসারের বাসা, ওরা আফসারের বাসাতেই উঠেছে।
জয়নাল মিয়ার বুকটা মুচড়ে ওঠে। সাত সকালে সে তবু কয় লোকমা ভাত মুখে দিয়ে আদালতে আসার জন্য তৈরি হয়েছে, কিন্তু মেয়েটা কিছুই মুখে দেয়নি। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারে না সে। এই মেয়ে তার কলিজার টুকরা।
মাঠের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে বাড়ির উঠানে পা দিয়ে যখন মেয়ের হাসি মুখে ‘বাবা’ ডাকটি সে শুনতে পায় তখন যেন তার কুঁড়েঘর সাত রাজার মণিমানিক্যেও ঐশ্বর্যে ঝলমল করে ওঠে। আর আজ সেই মেয়ের মুখে কোনো হাসি নেই।
বিষন্ন চোখে-মুখে জয়নাল মিয়া আদালত চত্বর দেখতে থাকে। এল শেপ দোতলা আদালত ভবনের নিচতলায় লম্বালম্বি বারান্দা। বারান্দার পশ্চিম দিকটায় কোর্ট পুলিশের অফিস আর এই অফিসের সাথেই কোর্ট হাজতখানা। ওদের সাথে থাকা পুলিশ দুইজন অনেকক্ষণ আগে সেই অফিসে ঢুকেছে। তারপর থেকে এখনো কেউ ওদের খবর নেয়নি। মেয়ের হাত ধরে জয়নাল বারান্দার সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ওর মনে ভয়ের বদলে এখন কৌতূহল এসে ভর করেছে।
কোর্ট বারান্দায় কত বয়সী, কত রকমের মানুষের যে ভিড়, তার ইয়ত্তা নেই। জয়নাল মিয়া লিমার হাত ছেড়ে দেয়। লিমার এসব হট্টগোল ভালো লাগছে না। ওর তলপেটে চাপ চাপ ব্যথা। হাতে ঘড়ি না থাকলেও ও বেশ বুঝতে পারছে প্রায় ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল। তলপেটের ব্যথা থেমে থেমে পাক দিয়ে শরীরের নিম্নাঙ্গে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ওর পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। বাবার অনুমতির তোয়াক্কা না করে বারান্দার এক কোণে বসে পড়ে লিমা। মেয়ের দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই জয়নালের। সে অবাক হয়ে কোর্ট কাচারির মানুষ দেখছে।
হাজারো মানুষের হাজারো কথা। কোনো কোনো উকিল হুড়মুড় করে কোর্টের ভেতর বের হচ্ছে আর ঢুকছে। বেশ কিছুক্ষণ হলো এক মহিলা এমন বিকট গলায় চিৎকার করছে আর উকিলকে শাপ-শাপান্ত করছে। মিনিটখানেকের মধ্যে দুইজন পুলিশ এসে মহিলাকে টেনে হিঁচড়ে বারান্দা থেকে বের করে দিল। জয়নালের পাশে দাঁড়ানো অল্প বয়স্ক একটা ছেলে এসব দেখে খুব মজা পাচ্ছে। থেমে থেমে খিক খিক করে হাসছে ছেলেটা। জয়নাল মিয়ার দিকে তাকিয়ে হলদেটে দাঁত বের করে সারা মুখ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললো,
-আইছিল সারেন্ডার দিতে। হি হি হি। দিছে… কোর্ট কাস্টডি কইরা। বোঝো ঠ্যালা। চান্দাবাজির মামলা তিন মাসের আগে ছাড়ন নাই।
জয়নাল কৌতূহলি হয়ে প্রশ্ন করে,
-আসামী মহিলার কী লাগে? স্বামী নি?
ছেলেটা খুব বুদ্ধিমানের মত ঘাড় নেড়ে উত্তর দেয়,
-হ! আমি এজলাশে ঢুকছিলাম, ম্যাজিস্ট্রার সাব জামিন দেয় নাই। আর বেটির সেই কী তেজ! উকিলেরে গাইল্লানো শুরু করছে।
ছেলেটি আবার খিক খিক করে হাসে। জয়নাল মিয়ারও এখন মজা লাগে। হঠাৎ তার মনে ভিন্ন এক প্রশ্ন পাঁক খায়। কিছু সময় ইতস্তত করে ছেলেটাকে প্রশ্ন করে,
-নারী নির্যাতনের মামলায় কয়দিনে জামিন হয় ভাই?
ছেলেটা অবাক হয় না। বোঝা যায়, এসব প্রশ্নের মুখোমুখি সে প্রায়শই হয়। এবার বরং খানিক চাপা গলায় বলে,
-কে ফাঁসছে? নাকি কাউরে ফাঁসাইবেন? কোন ধরনের নির্যাতন? রেইপ কেসে সহজে জামিন নাই। সমস্যা নাই, ভালা উকিল ধইরা দিমুনে।
একজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে আসছে লিমার দিকে। জয়নাল মিয়া তা দেখে ছুটে যায়।
-ম্যায়ার খাড়াইতে কষ্ট হইতাছে। আর কতক্ষণ লাগবো। ম্যায়ার আমার তলপেটে বেদনা। গায়ে জ্বর। খাওন নাই ঠিকমতোন।
মহিলা পুলিশটির পরনে নেভী ব্লু রঙের শাড়ি আর ব্লাউজের বদলে একই রঙের পুলিশী শার্ট। মহিলার মুখে কোন স্নিগ্ধতা নেই। বরং রুক্ষতার ছাপ স্পষ্টতর হয়ে সেই চেহারায় কেমন একটা পুরুষালিভাব চলে এসেছে। পেশাদারি গলায় সে জয়নালকে প্রশ্ন করে,
-রেইপ কেইস না? ভিকটিমরে এখানে বসায় রাখছেন কেন? যেই পুলিশ আনছে সেই তো আপনাদের কোর্ট স্যারের কাছে নিব। কামচোর, বারান্দায় রাইখ্যা ভাগছে। দিমুনে কোর্ট ইন্সপেক্টর স্যাররে নালিশ।
জয়নালের মাথায় দায়িত্ব-কর্তব্যের এতো বক্তব্য ঢোকে না। তার মাথার মধ্যে দুইটা শব্দ শুধু পাঁক খেতে থাকে। রেইপ কেইস! রেইপ কেইস! রেইপ শব্দটা ইংরেজি না বাংলা সে জানে না। কিন্তু শব্দটির অর্থবোধক উচ্চারণের সাথে সাথে তার শরীরে কাঁপন ধরে। যেন তার শীতার্দ্র শরীরে পরিচিত শব্দ গুচ্ছ বরফ কুচির মত আছড়ে পড়ে। জয়নাল মিয়া থই পায় না।
সেই যন্ত্রণা এড়াতে ধীর লয়ে জয়নাল মিয়া উত্তর দেয়,
-রেইপ কেইস না তো। আমার মাইয়ারে তো কিছু করে নাই। নাসির হারামজাদা ধইরা নিছিল। ভাইরা গিয়া ছুটাইছে।
এইবার মহিলা পুলিশের মুখ পূর্বের বেগ অতিক্রম করে ঝড়ো বেগে ছোটে,
-বুঝছি। আসামী হারামজাদার সাথে আপোস করছো তো মিয়া, এখন ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের সামনে মিথ্যা জবানবন্দি দিব ভিকটিম! মিয়া শরম নাই। মাইয়াটারে রেইপ করলো! বিচার চাও না? টাকা নিয়া খালাস করাইতে আইছো। শালার গ্রাইম্মা চামার!
ডুবন্ত বাবাকে উদ্ধার করতে লিমা জয়নালের হাত চেপে ধরে। ওর শরীরের চিনচিনে ব্যথা শরীরের নিচের অংশ অতিক্রম করে বুকে এসে আটকে গেছে। তবু বাবার অসহায় মুখে তাকাতেই লিমার ষোড়শী শরীরে কী এক অদৃশ্য শক্তি ভর করে। দীর্ঘদিনের নির্ঘুম, অভুক্ত শরীরের ক্ষয়িষ্ণুতার ভেতরেও সেই শক্তি আর আবেগের যোগফলে সব অন্ধকার বিলীন হয়ে যায়।
বাবার হাত দুইখানা ধরে লিমা গাঢ় স্বরে বলে,
-আমার বাপজানরে মন্দ কইয়েন না আপা!
এরপর লিমা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তাপহীন গলায় প্রশ্ন করে,
-বাপজান, সত্যিডা কইয়া দেই?
বাবাকে নিশ্চুপ দেখে লিমার বুক ভেঙে যায়,
-কই না বাপজান! বড় কষ্ট বাপজান! বড় কষ্ট!
জয়নালের ভেঙে পড়া বোধ যেন অকস্মাৎ জেগে ওঠে। মেয়ের নির্বুদ্ধিতায় আঁতকে উঠে সে। ডান হাতে মেয়ের মুখ চেপে ধরে জয়নাল মিয়া। টের পায়। লিমার গায়ে জ্বর। জ্বর তো আসবেই। দিন সাতেক আগে গলুইপাড়া বাঁশঝাড় থেকে মেয়েকে তুলে আনার পর, মেয়ে তার কত বার যে বাড়ির পুকুরে ডুব দিয়েছে তার ঠিক নেই। মেয়ের সেই ছটফাটানি দেখে জয়নালের স্ত্রী খাদিজার সে কী আর্তনাদ!
জয়নাল যতই তার মুখ বন্ধ করে ততই খাদিজার অর্থহীন ক্রন্দনে পুকুর পাড়ে উৎসাহী পড়শীদের ভিড় বাড়ে। গতকাল পুলিশ এসে ধমকে গেলে লিমার গোসল বন্ধ করে জয়নাল। এতবার গোসলে শরীর থেকে নাকি রেইপের চিহ্ন মুছে যাবে! শত দুঃখের মাঝে জয়নাল প্রাণ ভরে হেসেছিল কাল। এই চিহ্ন রেখে দিতে হয়! এ নাকি মামলার আলামত! তার মেয়ের গ্লানি মুছে ফেলার বদলে প্রমাণের জন্য শরীরে তার চিহ্ন রেখে দিতে হবে!
আর এর মাঝে কত লোক এসে তার চেয়ে বেশি চিহ্ন যে নিয়ে গেল! পত্রিকায় মেয়েকে নিয়ে সংবাদ করবে বলে ছবি তুলে নিয়ে গেল কত সাংবাদিক! সারা দেশের মানুষ নাকি লিমার করুণ মুখশ্রী দেখে মমতায় ভেঙে পড়বে! সহানুভূতিতে তার পাশে এসে দাঁড়াবে! তার বেলায়? পুরো গ্রাম ভেঙে মানুষ দেখে গেল, জয়নালের ধর্ষিতা মেয়ে লিমা দেখতে কেমন! লিমার তাদের বউ-মা-ঝি’র মতো দুই হাত-পা আছে কীনা, বা লিমার চলনে-বলনে কোনো ভ্রষ্ট শঙ্খিনীর বাঁক-চাহনি আছে কীনা! সেটা কি কিছু না?
জয়নালের বোধ বুদ্ধি যখন আবেগ আর নির্বুদ্ধিতার বেড়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখনই তাকে কুশলী নাবিকের মত পথ দেখিয়ে দেয় ওহাব মুন্সী। ওহাব মুন্সী মৌহার গ্রামের জ্ঞানী ও বিচক্ষণ লোক। সারা গ্রামের লোক তার পরিপক্ক চুল-দাঁড়ির কদর করে। জয়নাল মিয়া কোর্ট-কাচারি করছে শুনে বিচলিত হয়ে উঠেছিল ওহাব মুন্সী। মেয়ের পাপের কথা দশ গ্রামে প্রচার হওয়ার আগেই তার চিহ্ন মুছে ফেলার সহজ উপায় হিসেবে বলেছিল, নাসিরের সাথেই লিমার বিয়ে দেওয়ার জন্য। ক্ষণিকের জন্য জয়নাল মিয়া আঁতকে উঠলেও বুদ্ধিমানের মতো প্রস্তাবটি হাত পেতে নিয়েছিল।
এরপর গ্রাম্য বৈঠকের সফল পরিসমাপ্তি শেষে জয়নাল মিয়া অঙ্গীকার করেছিল যে, নাসিরের সাথেই মেয়ের বিয়ে দিবে। সেই সিদ্ধান্তের সাথে সাথে জয়নালের ঘুমহীন রাত আরও দীর্ঘ হয়ে এসেছে। সভ্যতার মধ্যে থেকে প্রচলিত রীতি অতিক্রম করার দুঃসাহস তার নেই। আর নিয়মতান্ত্রিকতার বেড়াজাল তৈরিতে ব্যস্ত মানুষগুলোকে উপেক্ষা করা তার জন্য আরও অসম্ভব। সেই সাথে সভ্যতার প্রাচীনতাকে যারা ধারণ করে, সভ্যতা বিনির্মাণের গল্প তাদের অজানা থাকবে, সেই বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার মতো সরলতা জয়নালের মধ্যে বিদ্যমান।
তবু প্রস্থানরত মেয়ের দিকে তাকিয়ে জয়নাল মিয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তা টের পেয়ে পিছন ফিরে বাবার মুখের দিকে একবার তাকায় লিমা। কোনো সম্ভাব্য নতুন উত্তর নেই সেই মুখে। তাই বাবাকে পেছনে ফেলে অনিচ্ছুক পায়ে এগিয়ে যায় ও। সাথে একজন মহিলা পুলিশ। এখন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিবে ও। তারপর সদর হাসপাতালে যাবে। হয়তো টু ফিঙ্গার টেস্টে ষোড়শী লিমার শরীরের মহা মূল্যবান কুমারীত্ব আর পাপের চিহ্ন খুঁজে বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করবেন ডাক্তার সাহেব। তারপর মেডিকেল রিপোর্টে লিখে দেবেন, ধর্ষণের কোনো চিহ্নই পাওয়া যায়নি।
লিমা আবার পিছন ফিরে তাকায়। তার বাবা অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মায়া লাগে মানুষটার জন্য। তার জোয়ান তাগড়া বাবা এই কয়দিনেই কেমন বুড়ো হয়ে গেছে। ক্রমশ লিমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ধীরে ধীরে জলের মোহর জমতে জমতে লিমার চোখের প্রাচীর উপচে যায়।