স্পার্ম ডোনেটর বনাম আমরা যারা মুক্তমনা

উম্মে সরাবন তহুরা:

কয়েকদিন আগে আমার অফিসে একটি মেয়ে আসে। সাথে তিনটি বাচ্চা। কোলেরটির বয়স এক বছর হবে না। বড়টির সর্বোচ্চ চার। মাঝে আরও একটি। মেয়েটির বয়সও পঁচিশ পার হবে না।

যৌতুকের ঘটনা। কী বিষয় জিজ্ঞাসা করতেই গট গট করে যা বলে গেলো- টাকার জন্য মারপিট করেছে। বলেছে টাকা না দিলে অন্য জায়গায় টাকা নিয়ে বিয়ে করবে। খুবই কমন ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই এরকম ঘটনা ফেস করতে হয়।

যখন অপরপক্ষ আসে, আমি খুব ভালো করে এদের লক্ষ্য করি। বার বার তাকাই। অনেক সময় তারা বিব্রত হয়। বিব্রত হয়, আমি তাকাই বলে, কিন্তু যে কারণে তার উপস্থিতি, সে কারণে নয়। আমি বুঝি, তবুও তাকাই। তাকিয়েই থাকি। খোঁজার চেষ্টা করি- এই সন্তানদের (স্ত্রী বাদ) জন্য তার ভেতর কতটা উতলা! যে আবেগ দেখার জন্য আমি বারবার তাদের দিকে তাকাই, বলাই বাহুল্য তার অনুপস্থিতি আমাকে কষ্ট দেয়, বেদনার্ত করে।

কী নির্লিপ্ত সেসব মুখ! যেন এপাশে দাঁড়ানো ওই ছোট ছোট হাতগুলো তাকে কখনও স্পর্শ করেনি! যেন এদের এই অনিশ্চিত জীবনে তার কিছুই যায় আসে না! যেন এদের সাথে তার কোন যোগসূত্র কখনো তৈরি হয়নি!

তাদের নির্ভার আর নির্লিপ্ত মুখগুলো আমার ভেতর ওলটপালট করে দেয়। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করে মেয়েটিকে। তুমি কেন বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব নিচ্ছো? কেন তার কাছে রেখে আসছো না? কেন নিজের অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়াচ্ছো? অর্থনৈতিক অবলম্বনহীন অবস্থাতেও এই দু:সাহস কোথা থেকে আসে? যেখানে নিজের খাওয়া-পড়ার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে আরও কতগুলো মুখ! মনে মনে বলি, এমন গাধা মানুষ হয়? বাচ্চাগুলো তার ঘাড়ে দিয়ে আসলেই তো পারতে!

মাথা ঠাণ্ডা হলে, আবেগ প্রশমিত হলে ভাবি- দায়িত্ববোধ সবার সমানভাবে থাকে না। তুমি যতই ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করো না কেন, তারাও তো ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার সর্ব উপায়ে সিদ্ধ হস্ত। বরং নির্লজ্জতায় তারা এক কাঠি ওপরে।

তাদের সাথে এরা পারবে কেন? স্বামী ব্যক্তিটিতো অপেক্ষায় আছেন ফের কখন আবার ছাদনাতলায় গিয়ে বসবেন। তার তো সুদিন আগতপ্রায়। সমস্ত দায় ওই মেয়েটির যে খামোখাই তাকে এখানে ডাকিয়ে এনে অসুবিধায় ফেলার চেষ্টা করছে। কী কুটিল মেয়েরে বাবা! আমার আর পছন্দ হচ্ছে না তো বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেলেই হয়। আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা কেন? সন্তান জন্ম দিয়েছো তুমি, দায় দায়িত্ব সব তোমার। এমন সহজ হিসেব না বোঝার কী হলো? আমি তো জন্মের সময়ও ছিলাম না!

যে ব্যক্তি সন্তান জন্মদানের সময় উপস্থিত থাকা জরুরি মনে করে না, অন্যান্যদের উপস্থিতিই যথেষ্ট ভাবে, তাকে আমি কিছুতেই স্পার্ম ডোনেটর ছাড়া অন্যকিছু ভাববো না, তা সে যত বড় মুক্তমনাই হোন না কেন।

এতো গেলো গল্পের প্রথম অংশ। এবার বলছি দ্বিতীয় অংশ। আমার বাসায় যে খালা সহযোগিতা করেন তার গল্পও একই রকম। তার ছোট মেয়ের যখন চল্লিশ দিন বয়স তখন তার স্বামী তাদের ফেলে আরেকটি বিয়ে করে। সেই ঘরেও একটি মেয়ে। এরপর খালার টিকে থাকার লড়াই। সেই সংগ্রাম পর্বটি বরং তোলা থাক। সেটিও কোনো অপরিচিত ঘটনা না। বরং এতোই নৈমিত্তিক যে ভালোভাবে স্পর্শও করে না। তো খালার এখন দু:খের দিন শেষ। তার আয় রোজগার ভালো। ছেলে একটা দোকানে কাজ করে। বড় মেয়ে একটা এনজিওতে কাজ করে। সবচেয়ে ছোটটির বয়স এখন ১৬। সে পড়াশুনা করে। বছরখানেক হলো- খালার স্বামী এখন খালাকে ঘরে নিতে চায়।

উল্টোভাবে (পড়ুন সোজাভাবে) বললে, সে খালার ঘরে উঠতে চায়। খালা একটু দোনোমনো অবস্থায় আছেন। সমাজের মানুষ কী বলবে সেটা নিয়ে। এই বয়সে আবার স্বামীর সাথে থাকার লজ্জায় খালা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। স্বামী বেচারার কিন্তু বেশ রাগ হয়। দয়া করে খালাকে আবার নিতে চেয়েছে, তাও খালারা করছে না। ‘দেমাগী বেটি’- উপাধি জোটে।

আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনি। সবচেয়ে যে সময়ে যাকে প্রয়োজন ছিল, যাকে ছাড়াই একটা জীবনের সমস্ত সংগ্রাম পার হয়ে এলেন, সেই মানুষটা এখন নিশ্চিত জীবনের লোভে আবারও তাকে কেবলমাত্র ব্যবহার করতে চায় বোঝার পরও তাকে ফিরিয়ে দিতে এতো দ্বিধা কেন? শারীরিক প্রয়োজন? সেখানেও তো এখন ভাটার টান! উদ্দাম দিনগুলোতে যখন প্রয়োজন মেটেনি, তখন এই অবেলায় কী প্রয়োজন? কেন? মায়া? একে ভালোবাসা বলতে বড্ড বাধে। আমার জানা নেই এর নাম কী?
আর ওই সুবিধাভোগী স্পার্ম ডোনেটর তাদের জন্য মায়াই হয়!!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.