মাহী ফ্লোরা: হুমায়ূন আহমেদ! এই মানুষটাকে নিয়ে আমার আসলে কিছুই বলার নেই। তবু কি কিছুই নেই? কিছু কিছু মানুষ কি সুন্দর করেই না কথা বলে। গুছিয়ে গুছিয়ে শব্দ বাক্য বিন্যাসে আবেগে কি চমৎকার করেই না বলে। আমি বলতে গিয়ে হড়বড় করে বলি, সব এলোমেলো করে ফেলি। আমার এই আবেগ প্রকাশের ক্ষমতা আসলে নেই। তাঁর জন্য যে আবেগ আমি ধারণ করে আছি তা বলার মত শব্দ নেই আমার।
একজন মায়াবতী’তে তিনি লিখলেন, আধুনিক মানুষের জন্য কথা বলার উপর বই থাকা দরকার। অপ্রয়োজনীয় সব বইয়ে বাজার ভর্তি, প্রয়োজনীয় বই খুঁজলে পাওয়া যায়না। কথা বলার আর্টের উপর ও একটা বই থাকা দরকার। কেউ কেউ এত সুন্দর করে কথা বলে, কেউ কথাই বলতে পারে না। যখন মজার কোন কথা বলে, তখন ইচ্ছা করে একটা চড় বসিয়ে দিতে।
আমি বলতে গেলেই অসহায় লাগে সত্যিই যদি এমন একটা বই থাকতো!
কোন বইটার কথা বলবো আমি! আমি একজন অন্ধ পাঠক। বই পড়াটা শুরুই হয়েছিল তাঁকে দিয়ে। নতুন এক ভুবনে প্রবেশ করলাম ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়। এক মামার লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম স্কুল থেকে ফেরার পথে। মজার ভূত নামে একটা বই মামা হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, সামনে সপ্তাহে আবার একটা বই নিয়ে যেও। সামনে সপ্তাহে আর যাইনি। অনেক দিন পর যখন আবার গেলাম আরেকটা বই নিয়ে এসেছিলাম। সেটাও হুমায়ূন নামের এক যাদুকরের।
এই সুযোগে বলে রাখি বইটা কখনো ফেরত দিইনি। সুযোগ পেলে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অবশ্য বই চুরির মত পবিত্র কাজ আর একটিও নেই।
মামা আমাকে সতেরো বছর আগেকার একটা বই এর জন্য দৌড়ানী দিতে পারে! কিন্তু তা দিক সেই যে তিনি বই পড়ার একটা বীজ বুনে দিলেন। বই এর লোভ আমার কখনো কমেনি। এরপর গোগ্রাসে গিলে গেছি তাঁর বই। কত প্রিয় মানুষের সাথে যে ভীষণ ঝগড়া হয়ে গেছে তাঁকে নিয়ে। যারা হয়ত তার লেখা পছন্দ করেনি কোনদিন। সে সময় তাদেরকে আমার আদর্শের শত্রু মনে হত এখনো হয়। তবে এখন নিজেকে বোঝাতে পারি এমন হতেই পারে। তখন পারতাম না। কেমন মূর্খ লাগতো ওদের মনে হত কয়েকটা বই পড়ে জ্ঞান ফলাচ্ছে হয়ত!
আরেকটু বড় হতেই সমগ্র নিয়ে আসতাম লাইব্রেরী থেকে। কত হলুদ বিকেল যে বাইরের ঘরের দরজাটার পাশে বসে কেটে গেছে। সবাই সামনের মাঠটায় খেলতো। আমি দু একবার তাকিয়ে আবার পড়তে শুরু করতাম। যেন আমার অন্য জগৎটার চেয়ে সুন্দর আর কিছু ছিল না।
আব্বা প্রতি তিনদিন পরপর একটা করে বই নিয়ে আসতেন তাঁর কলেজ লাইব্রেরি থেকে। আমার হুমায়ূন! আমার প্রিয় হুমায়ূন তাঁর বই সামনে না থাকলে আমি খেতে বসতাম না। আমার রাগ দেখে আব্বা হাসতো।
আমি বড় হবার পর আমার ভেতরে তাঁর জন্য ভালবাসা শুধু বাড়লোই। এইতো কদিন আগেও মাঝে মাঝেই উনার ফোন নম্বর বের করে হাতে নিয়ে বসে থাকতাম। কখনো সাহস করতে পারতাম না ফোন দেবার। কি হত যদি সাহস করে একবার ফোনটা দিয়েই বসতাম। একবার যদি বলতাম আমি আপনার অন্ধ ভক্ত, কি এমন হতো! উনার মৃত্যুর খবর শোনার পর এই কষ্টটা খুব তীব্র ছিলো। আমি আর নতুন কোন বই পড়বো না তার কেমন যেন এখনো ভাবতে পারি না! একবছর পুরো একটা বছর চলে গেছে! এভাবে হয়ত আরো অনেক দিন যাবে। আমার মত অসংখ্য মানুষকে কাঁদিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা যার ছিল তাঁর প্রতি ভালবাসা কখনো কমবে না।
তাঁর কাছেই তো পেয়েছি কবিতার প্রতি ভালবাসা। বলতে শিখেছি ,
আমার জলেই টলমল করে আঁখি/তোমার চোখের অশ্রু কোথায় রাখি!
অথবা জীবনানন্দের ঘাই হরিনীর খবর কিংবা শক্তির কবিতা। প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ অমর এক মানুষের নাম। বুকের ভেতর কষ্ট নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
”এভাবে নয় এভাবে ঠিক হয় না
নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে পাহাড় তাকে সয়না
এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয়না।
কিভাবে হয়, কেমন করে হয়?
কেমন করে ফুলের কাছে রয়!
গন্ধ আর বাতাস দুই জনে?
এইভাবে হয়, এমনভাবে হয়!”
লেখক পরিচিতি: ব্লগার, ১৯ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১১:৪৯ |