রূপা’র জন্যে কষ্ট হচ্ছে, চাপ চাপ কষ্ট!!!

নাদিরা সুলতানা নদী:

‘চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর’ হত্যা করা হয় মেয়েটিকে!
টাঙ্গাইলের মধুপুরে এক তরুণীর লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করার পর তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে, চারদিন আগে চলন্ত বাসে দলবেঁধে ধর্ষণের পর ওই কলেজ ছাত্রীকে হত্যা করা হয়….. এবং এবং …পড়ছিলাম একটি অনলাইন পত্রিকায় এই নিউজটি।

বলাই বাহুল্য হেডলাইনটা পড়ে আর আগাতে পারছিলাম না। না, ধর্ষণের নিউজ তো প্রথম না, প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা বা এই সময়ের অনলাইন পোর্টালে দেখছি। কোথাও যথাযথভাবে, কোথাও বা একেবারেই আর দশটা গতানুগতিক নিউজের মতো করেই।

আজ কাজ থেকে ফিরে ফেসবুকে নিউজ ফিড এ উঠে আসা নিউজ পড়তে যাবো এর মাঝেই বেশ কয়েকটা শেয়ার একবারে উঠে এলো। একই নিউজ, বেশ কিছু শেয়ার দেখেই পুরো নিউজে ক্লিক, চোখ বুঁজে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলাম, পড়তে পড়তেই যেন একটা মহাশূন্যের অতলে ডুবে যাচ্ছিলাম, আগাতে পারছিলাম না, যখন পড়লাম ‘নিহত রূপা খাতুনের বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশে। ঢাকার আইডিয়াল ল কলেজে পড়ালেখা করার পাশাপাশি একটি কোম্পানির প্রমোশনাল ডিভিশনে কাজ করছিলেন তিনি। তার কর্মস্থল ছিল ময়মনসিংহ জেলা সদরে।’

এইটুকু পড়েই কেন যেন একটা অদ্ভুত ঘোরের মাঝে চলে গেলাম আজ। রূপা খাতুন যেন সেই ১৯৯৩/১৯৯৪ এর ঢাকা টু ময়মনসিংহে বাসে করে যাওয়া এক তরুণী (!) নাদিরা সুলতানা নদী… অনেক সাহস করে পড়লাম নিউজটা।

যাদের জানা নেই সেই নিউজ থেকে, আরো কিছু অংশ তুলে আনি, নিউজটাতে বলা হচ্ছে, বাসের কর্মচারিদের গ্রেপ্তারের পর তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেই সন্দেহেরই সত্যতা পান তারা। ‘ওই পাঁচজনের মধ্যে তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছে। তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, কালিহাতি থেকে মধুপুর পর্যন্ত রাস্তায় চলন্ত বাসে পর্যায়ক্রমে রেপ করা হয় মেয়েটিকে।

রূপার বড় ভাই জানান শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে বগুড়া গিয়েছিলো তাঁর বোন। এক সহকর্মীর সাথে ফিরে আসছিলো। সেই সহকর্মীর গন্তব্য আগেই হওয়াতে তিনি নেমে যান, এরপরই একটা সময় মেয়েটির এই অন্ধকার ভুবনে চিরতরে যাত্রা।

মেয়েটি পড়ালেখা করছিলো, সাথে চাকরি। আমি নিজে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি, আমার জানা আছে এই সংগ্রামের পথগুলো। কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে মেয়েটি এগিয়ে যাচ্ছিলো। শুধু মেয়ে শরীরটা বহন করার জন্যেই কী ভীষণ ভীষণ মর্মান্তিক পরিণতি দিয়ে শেষ হয়ে গেল জীবনটা! ‘চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর’ হত্যা করা হয় মেয়েটিকে!
আচ্ছা মেয়েটির উপর যখন অমানুষগুলো এগিয়ে আসছিল, ওর কী ছোটবেলায় ওর বাবা যে ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো ‘সোনা-মা আমার’ সেটা মনে পড়ছিলো? ওর ভাইয়ের সাথে শেষবার যে খাবার কমবেশি নিতে গিয়ে খুনসুটি হতো সেই কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো? মেয়েটা কী খুব করে মায়ের বুকে লুকাতে চাইছিলো আরো একবার…?

মা’কে শুধু মায়ের মুখটাই কি ওর মনে পড়ছিলো? না কি ওর বোধ শক্তি সব ঐ কালো মুখগুলো দেখেই মরে গিয়েছিলো, ওর খুব খুব ঠাণ্ডা লাগছিলো। ওর আসলে কিছুই মনে পড়ছিলো না… কিচ্ছু না।
“মেয়েটি তাদের বলেছিল, সঙ্গে যা টাকা পয়সা আছে, তা নিয়ে যেন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ধর্ষণের পর ঘাড় মটকে, মাথা থেঁতলে তাকে হত্যা করে বাসের কর্মচারিরা লাশ রাস্তায় ফেলে চলে যায়।”

শেষবার নিঃশ্বাস নিতে যেয়ে কি আরো একবার তাকিয়ে ছিলো সেই মুখগুলোর দিকে? ও কি বলে যেতে চেয়েছিলো ওর বুকের গভীরে যত্ন করে রাখা স্বপ্নটার কথা? রূপা’র বিবর্ণ পৃথিবীতে তলিয়ে যেতে যেতে সবটুকু ঘৃণা নিয়ে ও-কি কষে একটা লাথি দিতে চেয়েছিলো এই নির্যাতক পুরুষ পৃথিবী’কে?

ও কি খুব করে তীব্র ঘেন্নায় হেসে উঠেছিলো ‘ধর্ষণকে ঘিরে, ক্রমশঃই ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতির পরিপাটি পুরুষদের নির্বাক মৌন ভূমিকার বাংলাদেশকে দেখতে যেয়ে… ও কি বলতে চেয়েছিলো, এভাবে রূপা’রা সব হারিয়ে গেলে তোমাদের পৃথিবী কী ভীষণ সুখী এক পৃথিবীই না হবে… বাঁচো, তাইলে তুমুল হয়ে নাচো তবে তোমাদের পুরুষত্ব নিয়ে!

নিরবে নিভৃতে প্রতিদিনই নানান ভাবে নারী শিশু, কন্যা শিশু নির্যাতন চলছে। কারো দেহ মৃত্যু ঘটছে, কারো বা জীবন মৃত্যু। তীব্র প্রতিবাদ করতে গেলেও আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে ‘আমাদের আবেগ, ভাষা অনুভুতি না আবার সমাজের ভালো মানুষ, বিশেষ করে নারীবাদকে ঘৃণা করা পুরুষকে না আবার আঘাত করে!

লড়াকু মেয়েগুলোকে বাঁচাতে আমরা কি কিছুই করবো না! নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা এবং মেয়েদের প্রতি অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সবই আজ হতাশার…
যারা ব্যথিত হচ্ছি, কষ্ট পাচ্ছি, দিনশেষে শুধু নিজেরাও মেয়ে শরীর বহন করার জন্যেই একটা নীল বেদনা নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছি তাদের কথাগুলো তো সব রূপার কাছে সময়মতো পৌঁছাতেও পারছি না!

নিজের কথা যদি বলি, কত যে কৌশলে বাসে ট্রেনে একা চলেছি… কেউ শিখিয়ে দেয়নি। নিজেই নিজের মত করে অবস্থা মোকাবেলা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সময়টা পার করেছি।

মেয়েদের একা চলা, নিজেদের নিরাপত্তা বিধানে যা যা করণীয় যার যা জানা আছে কৌশল, রূপাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। যতদিন না এই রাষ্ট্র দিতে পারছে নিরাপত্তা, বিচারের বাণী নিভৃতেই কাঁদছে… রূপা’দের বাঁচাতে কেউ কি আছে কোথাও?

কোন একজন রূপা’র জন্যে যদি আজ পুরো বাংলাদেশের এক কোটি পুরুষ দাঁড়িয়ে বুকের মাঝে ওর থেঁতলে যাওয়া শরীরটাকে ধারণ করে বলে উঠতো ‘আমাদের স্বজাতি কেউ তোমাকে যে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে, বেঁচে থাকা রূপাদের জন্যে এই বাংলাদেশ নিরাপদ রাখবো আমরা। আমাদের বিকৃত মানসিকতায় আর হারিয়ে যেতে দেবো না আর কোনো রূপাকে… তাহলে হয়তো কে জানে রূপা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারতো… !!!

নাদিরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

শেয়ার করুন: