নারীর প্রতি সহিংসতায় কোনো শ্রেণী বিভেদ নাই, বিচারহীনতায়ও নাই

জিনাত হাসিবা স্বর্ণা:
ফেসবুকের পাবলিক পোস্ট কিংবা যেকোনো দলীয় (ফরম্যাল এবং ইনফরম্যাল) বা পাবলিক ফোরামের আলোচনাতেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে বাংলাদেশে অসচেতন এবং অসংবেদনশীল মানুষের কমতি নাই। তাদের কথাবার্তা আমি কয়েক মুহূর্তের বেশি আমলে নেই না এবং এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া বা মতামত জানাতে সময় দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। কিন্তু যাদেরকে সচেতন এবং সংবেদনশীল বলে জানি এবং মানি, তাদের যখন আপাত ‘সংবেদনশীল বক্তব্য’ রাখতে দেখি যা কিনা পরোক্ষভাবে এবং প্রকারান্তরে কোনো ধর্ষকের অবস্থানকে পোক্ত করে, তখন একটু থমকে দাঁড়ানো জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
গতকাল দুই বা ততোধিক পোস্ট দেখলাম যেখানে হযরত আলী ও তার মেয়ে এবং বনানী ঘটনার নির্যাতিত মেয়েদের তুলনা করে ‘সিলেক্টিভ প্রতিবাদের’ অভিযোগ তোলা হচ্ছে যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ হলো ‘পার্টিতে যাওয়া উঁচু অবস্থানের’ মেয়েদের ধর্ষণের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছেন, তারা হযরত আলী আর তার মেয়ের পক্ষে দাঁড়াননি।
এ ব্যাপারে কিছু কথা আছে আমার।
প্রথম কথা হলো, যারা আজকে বনানী ঘটনার জন্য দাঁড়িয়েছেন তারাই পূজার জন্য, তনুর, হযরত আলীর আর তার মেয়ের জন্য প্রতিবাদ করেছেন। সে হিসেবে অভিযোগটা ভুল। ধরে নিলাম এর বাইরে অনেকে আছে যারা হযরত আলীর মেয়ের বেলায় স্ট্যান্ড নেননি, কিন্তু বনানীর বেলায় নিচ্ছেন। সেটার কারণ হতে পারে অনেক রকম। কেন সরাসরি এই কনক্লুশন টানা যে অর্থের দৌড়ে পিছিয়ে পড়াদের পক্ষে নেই বলেই প্রতিবাদকারীরা বনানীর শিক্ষার্থীদের জন্য অবস্থান নিয়েছেন?
ঘটনাটা ঘটেছে ঢাকার বনানীতে, শহরের লোকের একেবারে হাতের নাগালে। এখানে শহরের মানুষ প্রতিবাদ না করলে করবেটা কে? যারা সমাজ উন্নয়নে নিজেকে আগাগোড়া নিবেদন করেননি, সে নিজের ধারে কাছের এবং সমপর্যায়ের ঘটনাতেই শুধু নিজেকে সম্পৃক্ত করবেন এটাই কি স্বাভাবিক নয়? তাছাড়া যে একবার দাঁড়িয়েছে তাকেই কেন বার বার দাঁড়াতে হবে? অন্যথায় তাকে হিপোক্রিসি আর পক্ষপাতিত্বের দায় কেন বইতে হবে? যে আগের ঘটনায় দাঁড়ায়নি তাকে ‘আগেরবার কেন দাঁড়ায়নি’ সেজন্যে অভিযুক্ত করা সঙ্গত নাকি এবারের স্ট্যান্ডের জন্য ধন্যবাদ দেওয়া? যে মানুষটি ধর্ষণের প্রতিবাদ করার জন্য প্রথম দাঁড়িয়েছে তাকে নিরস্ত করারই কি নামান্তর নয় এই অভিযোগ?
দ্বিতীয় কথা হলো, এই ধর্ষকরা উঁচু তলার ক্ষমতাধর বলে পিছলে যাবে বলেই এদের পেছনে উঠে পড়ে লাগা, যে মেয়ে ধর্ষণের শিকার তার আর্থিক অবস্থান অন্য ধর্ষণের শিকার মেয়েটির তুলনায় ভালো বলে নয়। তুলনাটা এক নির্যাতিতের সাথে আরেক নির্যাতিতের করাই অন্যায়। তাতে কোনো একটি নির্যাতনকে অনুমোদন দেয়া এবং অন্তত একজন নির্যাতকের অবস্থানকে শক্ত করা হয় (নির্যাতকের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছে তাদের আক্তমণ করা মানে নির্যাতকের রেহাই পাওয়ার পথ সুগম করা)। তুলনাটা হযরত আলী ও তার মেয়ের নির্যাতক চেয়ারম্যান এবং বনানীর দুই শিক্ষার্থী ও নির্যাতক সাফাত-নাইম এর ক্ষমতার সম্পর্কগত অবস্থানের করা উচিত। দুই ক্ষেত্রেই নির্যাতক নির্যাতিতের তুলনায় অনেক ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী। সুতরাং যে যেখান থেকেই প্রতিবাদ করছেন সেটা কোনো বড়লোক বা গরীবের জন্য নয়, বরং ক্ষমতাধর ও প্রতিপত্তিশালী নির্যাতকের বিরুদ্ধে। দেখার চোখটা পরিষ্কার থাকা জরুরী, ‘আমি গরিবের পাশে আছি এবং বড়লোকের সাথে নাই’ এই অবস্থান নিতে গিয়ে নির্যাতনকারীর অবস্থান দৃঢ় করার মতোন বোকামী রীতিমতোন অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে।
তৃতীয়ত এবং সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ধর্ষণের কেস এর সবচেয়ে বড় দূর্বলতা ধর্ষণের শিকার মেয়ে/নারী এবং তার পরিবারের সামাজিক ভয় এবং অসহযোগিতা; যা কিনা বনানীর ক্ষেত্রে মেয়ে দুইজন কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। এর পরেও যদি বিচার নিশ্চিত করা না যায় তাহলে লোকের মধ্যে এ ধরনের কেসের বিচার চাওয়ার ভয় ভাঙানোর একটা বড় সুযোগ হারিয়ে যাবে।
‘সিলেক্টিভ প্রতিবাদে’ মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও অবস্থানের প্রতিফলন ঘটে মাত্র। একদল এটাতে দাঁড়ালে অন্যদল ওটাতে দাঁড়িয়ে ব্যালেন্স আসাও সম্ভব। কিন্তু যে সময় কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সবচেয়ে জরুরী তখন সিলেক্টিভ প্রতিবাদের ধোঁয়া তোলা অন্যায়কারীকে সুবিধাজনক অবস্থান আর প্রতিবাদকারীকে ভঙ্গুর অবস্থানে নিতে সাহায্য করে। যার যার পছন্দ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে ‘কিছু’ অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যদি হয় অনুচিত, তাহলে আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের এর জন্য দায়ী করে কোণঠাসা করার চেষ্টা অন্যায়।
এক ধরনের শ্রেণী বিদ্বেষ এই বক্তব্যগুলোয় ফুটে উঠছে। প্রকাশটা এমন যেন ‘পার্টিতে গিয়ে’ যে মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয় তার পক্ষে বিচারের দাবী তোলা তেমন জরূরী না। অবস্থাপন্ন হওয়ার জন্য কারো ন্যায় বিচার পাওয়ার দাবীতে ঘাটতি হওয়াটাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করলে তো এদেশে মধ্যবিত্তেরও (যাদের মধ্যে ‘উচ্চবিত্তের’ প্রতি বিদ্বেষ আর নিম্নবিত্তের প্রতি সময়ে সহানুভূতি আর সময়ে অবজ্ঞা দেখা যায়) দরকার নাই এই রকম বিচারের দাবীতে স্থান পাওয়ার, তারা তো অবশ্যই হযরত আলীর তুলনায় বিত্তশালী। ধর্ষণ এর ঝুঁকি থেকে অন্য যে কারো মতোই এদের কারো পরিবার মুক্ত নয়। ধর্ষণের বিচার যদি এমন আপাত সহানুভূতিশীল অথচ আদতে বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিতে তারা দেখতে থাকেন তাহলে এদের পরিবারের কেউ এই নির্যাতনের মুখে পড়লে (না হোক) তখন তারা কী করবেন?
শ্রেণীবৈষম্য আছে আমাদের মধ্যে। সেটা শুধু নিম্নমূখী নয়, ক্ষেত্রবিশেষে উর্ধ্বমূখীও বটে। এই অভিযোগেও তার প্রতিফলন আছে। কিন্তু এটা দ্রুত বোঝা প্রয়োজন যে নারীর প্রতি সহিংসতায় কোনো শ্রেণিভেদ নাই। এই সহিংসতার বিচারহীনতায়ও কোনো শ্রেণীভেদ নাই। তফাৎ শুধু এই যে শাজনীন ধর্ষণ ও হত্যা মামলা ২০ বছর ধরে চলে! আর অন্যগুলি চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে।
ধর্ষণ আর যৌন হয়রানি ঘরে ঘরে হয় এবং প্রত্যেকটা ঘটনারই প্রতিবাদ ও বিচার হওয়া জরুরী, কোনো একটার জন্য আরেকটা বাদ পড়া কাম্য নয়।
১৩ মে ২০১৭
শেয়ার করুন: