পুরুষতন্ত্র নাকি প্রভুতন্ত্র?

নায়না শাহ্‌রীন চৌধুরী: কদিন আগে কারিনা বা ঐশ্বরিয়া’র নামের উপাধি পরিবর্তন এবং তাদের সন্তানদের নামের শেষে মাতার বদলে পিতার উপাধি বসানোর বিপক্ষে একটা লেখা পড়লাম।

নায়না শাহরীন চৌধুরী

লেখকের বক্তব্য ছিল, কেন কারিনার সন্তানের নামের শেষে কাপুর স্থান পেলো না, কিংবা ঐশ্বরিয়া’র মেয়ের নামের শেষে রাই হলো না। লেখকের হয়তো মনে আসেনি রাই বা কাপুর একজন পুরুষের নামের শেষ। এখানে কারিনার বাবা, ঐশ্বরিয়া’র বাবা রয়ে যান। মেয়েদের পরিচয় থাকে না। একজন পুরুষের নামের সাথে জড়িয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের বেঁচে থাকতে হয়। যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে, তাই আমরাও পুরোটা ধরতে পারি না। তাই উপাধি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গিয়ে নিজের নামের শেষটা দেখে আমতা আমতা করে বসে পড়ি। কারণ নামের লেজ ধরে কোনো না কোনো পুরুষ অধিকার ফলায়। তা সে স্ত্রী বা সন্তান, যেই হোক। যার সম্পত্তি সে ট্যাগ লাগাতে ছাড়বে কেন?

নাম নিয়ে আমার তেমন আপত্তি নেই। নারী সন্তান ধারণ করে মা হয়। সেটা সবাই দেখে। স্বীকৃত সত্য। বাবা বেচারা’র পিতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ওটাই তো পথ। জনক নামে একটা নাটক দেখেছিলাম। পিতৃত্বের সঠিক স্বীকৃতির ব্যাপারে জনকের হতাশা হৃদয় ছুঁয়েছিল।

নামের শেষে নিজের নাম জুড়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে পুরুষ।

আমার আপত্তি বিয়ের পর নারীর নাম পরিবর্তন। অনেক মেয়ে স্বেচ্ছায় ভালোবেসে নাম পরিবর্তন করে। আমার ঠিক জানা নেই কোনো পুরুষ ভালোবেসে নাম পরিবর্তন করেছে কিনা! আমরা মেয়েরাই হয়তো ব্যাপারটা হজম করতে পারবো না। জিনিসটা ভীষণ “মেয়েলী” হবে, তাই না?

নাম কেন পরিবর্তন হয়? যখন কেউ এক ব্যবসা থেকে আরেক ব্যবসা করে তখন দোকানের নাম পরিবর্তন হয়। আরও ভালো করে বলতে গেলে, মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নাম পরিবর্তিত হয়। তাহলে আমরা যারা বিয়ের পর হাসিমুখে নাম পরিবর্তন ব্যাপারটায় ভীষণ রোমান্টিকতা খুঁজে নেই, অথবা আমাদের মিষ্টির মধ্যে ক্যাপসুল ভরে এই জিনিসটা গেলানো হয়, আমরা কি নিজেদের মাল ম্যাটেরিয়াল প্রমাণ করছি না?

অনেকে ভিন্নমত পোষণ করবেন। কিন্তু স্বামীর –সমার্থক শব্দ প্রভু, এটা তো মানতেই হবে। তাই  তার আওতাধীন, তার বাধ্যগত রাখার একটা সুইট ক্যারেট বা গাজর আমাদের সামনে রাখার এই সংস্কৃতি আমরা শুধু  প্রশ্রয়ই দেই না, আমরা এতে গৌরবান্বিত হই।

আমি নিজেই অনেক অপরিচিত মানুষকে আমার স্বামীর নাম ধার করে, আমি মিসেস অমুক পরিচয় দেই। সত্যি কথা বলতে এতে নারী সমাজের বিরাট অপরাধ হচ্ছে তা মনে করি না। কিন্তু অনেক পুরুষকে দেখেছি নিজের স্ত্রীর নাম মুখে আনতেও বিরাট আপত্তি। কী এক প্রছন্ন লজ্জা কাজ করে।

একটা ঘটনা বলি, আমাদের পরিচিত এক প্রাক্তন সহকর্মী। তার স্ত্রীও আমাদের সহকর্মী ছিল। উভয়েই আমাদের সাথে বেশ পরিচিত। হঠাৎ পুরুষ সহকর্মীটির সাথে কোথাও দেখা, বললো, ওয়াইফের জন্য ওষুধ নিতে এসেছে। ‘ওয়াইফ’ কথাটায় কেমন কানে বাজলো। দুজনকে নামেই চিনি। মেয়েটির নাম উচ্চারণ করলো না কেন, খুব অবাক লাগলো।

নাম খুব বড় ইস্যু নয়। বাবা ভালবেসে সন্তানের নাম রাখবেন, স্ত্রী চাইলেই গ্রহণ করতে পারেন স্বামীর নাম। কিন্তু যখন কোনো কিছুতে কাউকে বাধ্য করা হয়, যখন নিজের ডিগনিটি বিসর্জন দিয়ে আমরা আত্মপরিচয় সংকটে ভুগি, তখন নামের ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানো বাতুলতা মনে হয়। পরিচয় হোক, কর্মে, জ্ঞানে। নামে নয়।           

শেয়ার করুন: