ওড়না নামের রক্ষণশীলতা আর কতদিন?

পারভীন সুলতানা ঝুমা: বাড়িতে আমি ম্যাক্সি পরে থাকি। শুধু ম্যাক্সি। কলিং বেলের আওয়াজ শুনলে ছুটাছুটি করতে হয় ওড়নার খোঁজে। ‘আমার ওড়নাটা কোথায়? তটস্থ হয়ে উঠি। রান্নাঘরের দরজার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম? নাকি ডাইনিং রুমে চেয়ারের উপর? নাকি আজকে ওড়নাটা বেরই করা হয়নি? ক্লোজেটে রয়ে গেছে? কী মুশকিল!

hijab-5ওদিকে দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটির ধৈর্য্যের সীমা পার হয়ে যাচ্ছে। দরজার পীপিং গ্লাস দিয়ে যদি দেখি কোনো নারী অতিথি অপেক্ষা করছে, তাহলে ওড়না নিয়ে টেনশান দূর হয়, একটা স্বস্তির নি:শ্বাস ছেড়ে দরজাটা খুলতে পারি। কিন্তুু যদি সে হয় পুরুষ ,আরও যদি হয় ড্রাইভার, হকার বা ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার, তখন ওড়নাটি শরীরের সঙ্গে ভালোভাবে জড়িয়ে দরজাটা খুলি।

সাতান্ন বছরে এসেও এভাবে ওড়নার জন্য ব্যাতিব্যস্ত হতে গেলে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিই। এ কোন সমাজে বসবাস আমার? কেন যা ইচ্ছা পরতে পারবো না? আমার আব্রু  রক্ষার জন্য যতোটুকু, ঠিক ততোটুকু! যে পোশাক আমাকে আরাম দেয়, স্বস্তি দেয়, সে পোশাক পরার অধিকার আমার নেই।

পুরুষের চোখ থেকে নিজেকে বাঁচানোর বিষয়টি যেন মূল কারণ এদেশের নারীদের পোশাক পরার পিছনে। দশ বছর বয়সে ওড়না পরা শুরু করতে হয়েছিল, কারণ আমার ‘ডেভেলপড’ শরীর ছিলো। স্কুলের ক্লাস টিচার একদিন ডেকে বললেন, ‘ওড়না পরে আসবে’। প্রচণ্ড মন খারাপ করে বাড়ি  ফিরলাম। কাঁদো কাঁদো হয়ে মাকে বললাম, টিচার বলেছে এবার থেকে ওড়না পরে আসতে।

ক্লাসের একটি মেয়েও তখন ওড়না পরে না। শীতের সময় আমাদের যাদের ‘ডেভেলপ্ড’ শরীর ছিল, স্কুল ড্রেসের উপর সোয়েটার জড়িয়ে নিজেদের ‘ডেভেলপমেন্ট’ ঢাকতাম। শীত চলে যাওয়ার পরও সোয়েটার ছাড়তাম না। এ নিয়ে অন্য মেয়েরা হাসাহাসি করতো। তখন ছোট মেয়েরাও ‘পাকা’ ছিলো। কারণটি বুঝতে পারতো। গরম চলে আসার পড়ে তো আর এভাবে  নিজেকে ‘উন্মাদ’ প্রমাণ করা যায় না। তাই সোয়েটার বাদ দিলাম, খুব অস্বস্তিতে থাকতাম। স্কুল ব্যাগটা বুকের কাছে চেপে ধরে গাড়িতে উঠানামা করা, ক্লাস পর্যন্ত যাওয়া, ডেস্কের সঙ্গে বুক চেপে রেখে বসে থাকা। কীভাবে নিজের শরীরের ডেভেলপমেন্ট লুকানো যায়! এতো কিছুর পরও টিচারের চোখ এড়ানো যায়নি।

আমার প্রগতিশীল মা-বাবা টিচারের এ নির্দেশ শুনে হতভম্ব হলেন। বাবা হেডমিস্ট্রেসকে ফোন করলেন, কী বলেছেন জানি না, পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন, হেডমিসট্রেসকে দেওয়ার জন্য। আমি তাই করলাম। ক্লাস টিচার আমাকে আর কিছু বলেননি ঠিকই, কিন্তুু স্কুলে সালোয়ার-কামিজ পরা শুরু করলাম ক্লাস ফাইভ থেকে। ফ্রকগুলো বানানো হলো সামনে বুকের উপর ফ্রিল, কুচি বা অন্য ডিজাইন দিয়ে। এরপরও ১১/ ১২ বছর বয়স থেকে প্রথমে বাইরে ও পরে বাসায় সালোয়ার কামিজ শুরু হলো, সেই থেকে শুরু হলো বুক ঢাকার কসরত।

ওয়েস্টার্ন ড্রেসের প্রতি দুর্বলতা ছিল। বাবা বিদেশে গেলে প্যান্ট-শার্ট, লং স্কার্ট ইত্যাদি আনলেও সেটি পারিবারিক পার্টি এবং বন্ধুদের গেদারিং ছাড়া পরা যেতো না। সত্তুর দশকের প্রথম দিকে ‘ভোগ’ পত্রিকা দেখে ম্যাক্সি বানাই। সামনে  অবশ্যই ফ্রিল ছিলো। নিজের অসুবিধা হয়নি।

jhuma-apa
পারভীন সুলতানা ঝুমা

আমার ম্যাক্সি ধার নিয়ে এক বন্ধু পরলো। তারপর হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো, ‘তোর এ্ ড্রেস আর পরবো না।’ ‘কেন?’ ‘এক বিয়ে বাড়িতে এ ড্রেস পরে গেছি। কতগুলো লোক কী বললো জানিস?’ ‘কী?’ বললো,‘বুক দেখিয়ে হাঁটে।’ তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম, ‘বুক থাকলে তো দেখা যাবেই। তাদের নিজেদের  বুক নাই দেখে হিংসা করছে।’ তবে পরে সেই ড্রেসটা পরার সময় আমি সতর্কভাবে দেখতাম, আসলে বুক দেখা যাচ্ছে কিনা।

তোমার বুক তোমার হাত-পার মতো একটা অঙ্গ ছাড়া আর কিছু না, কোনো মা-বাবা তার কন্যাকে এ কথা বলে না এ দেশে। মা-বাবা তা মনে করলেও হাঁটতে ফিরতে মানুষেরা তো তা মনে করে না। তাই সবসময় বলতে হয় ‘ওটা ঢাকো’। একটা নিবন্ধে পড়েছিলাম, মানুষের প্রথম দৃষ্টি নাকি চোখের উপর পড়ে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ পুরষের প্রথম দৃষ্টি নারীর চোখের দিকে নয়, তার বুকের দিকে পড়ে। অন্য দেশের পুরুষেরাও নারীর এই “শারীরিক সৌন্দর্য্যর’ প্রতি আকৃষ্ট হয়।

নইলে এতো নগ্ন বক্ষ নারীর ছবি কেন সর্বত্র? তবে সেই নারীরা নিজেদের এই অঙ্গ দেখাতে চায় বা তা নিয়ে ব্যবসা করতে চায় ,তাদের কথা আলাদা। কিন্তুু পাশ্চাত্যে বা দূরপ্রাচ্যের দেশের টিনএজ বা সদ্য বড় হওয়া মেয়েদের বুক ঢাকতে এতো চেষ্টা চালাতে হয় না, কারণ তারা তো জানে তারা যে পোশাক পরেছে, তা দিয়েই কাজ চলে। বাড়তি কাপড় পরে তা ঢাকা দিতে হবে তা তারা নিজেরা তো বটে, তার ছেলে সহপাঠী থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটের পুরুষরাও মনে করে বলে মনে হয় না। তা নাহলে এরা এতো স্বাচ্ছন্দে শুধু শার্ট প্যান্ট, টপস স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়াতে পারতো না। আমাদের মতোই বুকের উপর বাড়তি কাপড় জড়াতে হতো।

কিশোর বয়সে বিশেষ করে টেলিভিশনের ইংরেজি সিনেমাগুলো দেখে তাদের মতো পোশাক পরার সুযোগ না পাওয়ার আফসোস হতো, তখন মনে হতো  পরবর্তিতে আমাদের কন্যারা হয়তো অবাধে প্যান্ট-শার্ট বা স্কার্ট-টপস পরে ঘুরে বেড়াতে পারবে। এখন দেখি এক কাঠি সরস। শুধু বুক ঢাকা নয়, এখন মেয়েরা মাথাও ঢেকে ফেলছে বাড়তি কাপড় দিয়ে। সবদিক দিয়ে এতো আধুনিক হচ্ছি, শুধু পোশাকেই পিছনে চলছি।

বুক ঢাকার চিন্তা আমার মতো পঞ্চাশোর্দ্ধ নারীকে যেমন করতে হয়, তেমনি সদ্য কিশোরী মেয়েটিরও করতে হচ্ছে। একজন-দুজন করে পোশাকের এ প্রথা কি ভাঙ্গা যায় না? পথে-ঘাটে হেনেস্থা হবার ভয়? ইদানিং পাজামা-পাঞ্জাবী পরা দাড়িওয়ালা মানুষগুলো, মাথার কাপড় পরার জন্য রাস্তাঘাটে মেয়েদের কানে ফিসফিস করে বয়ান দিয়ে যাচ্ছে। বুকের উপর আলগা কাপড় না দিয়ে চললে তারা কী করবে তা কে জানে! তবে, কীই আর করতে পারবে? মাথায় কাপড় না দেওয়া নারীদের ওরা কী করতে পারছে?

সাহসী কয়েকজন নারী যে এধরনের পোশাক পরে বের হচ্ছে না, তা নয়। তাদের বাহবা দিই। কিন্তু তাদের সংখ্যা এতো কম। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে কলকাতা শহরে দেখেছি অবাধে মেয়েরা শার্ট প্যান্ট পরে চলাফেরা করছে। সেখানের সাধারণ রেস্তোরাতে দেখেছি মিনি স্কার্ট পরে মেয়েদের নির্ভয়ে খাবার অর্ডার দিতে।

আমাদের মেয়েদের আমি মিনি স্কার্ট পরার কথা বলছি না। যদিও সে পোশাকে কী ক্ষতি, জানা নাই। প্যান্ট শার্ট বা জিনস আর ফতুয়া পরে আমাদের মেয়েরা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারে না? জিন্স আর টপস পরছে বটে, তার সঙ্গে গলায় ঝুলাচ্ছে ওড়না। আমি ওড়নার বিপক্ষে না। সালোয়ার কামিজের সঙ্গে সুন্দর ওড়নার প্রতি লোভ আছে। নিত্যদিনের কাজে যারা শার্ট প্যান্ট পরতে চায়, পাছে লোকে কিছু বলার ভয়ে পরতে পারে না, তারা যেনো তা পরার পরিবেশটা পায়।

সাবলীল আর সহজ পোশাক পরে চলাফেলা করার অধিকার কি কোনদিন আমাদের হবে না? কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ওড়না খোঁজার দিন চলতেই থাকবে? তবে শুধু পুরুষদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বহু নারী আছে যারা পশ্চিমা পোশাক, ওড়না ছাড়া পোশাক পরা মেয়েদের দেখে চোখ কপালে উঠিয়ে ফেলে। পোশাক নিয়ে এই রক্ষণশীলতা ঝেড়ে ফেলতে হবে তাদেরও।

শেয়ার করুন: