ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দোলাচলে আকতার জাহানেরা কোথায়!

মুমিতুল মিম্মা: অধ্যাপক কাবেরী গায়েনের গত ১২ সেপ্টেম্বরের লেখা “আকতার জাহানের সুইসাইড নোট” এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত কয়েকদিন উইমেন চ্যাপ্টারে প্রকাশিত সবগুলো লেখা আমি পড়েছি । আমার মনে হয়েছে এই হত্যা আর আত্মহত্যার চাপে আর লোকনিন্দায় আসল ব্যাপারটা হারিয়ে যাচ্ছে।

mimma
মুমিতুল মিম্মা

আমাদের মেয়েদের আর্থসামাজিক অবস্থান বদলালেও, বদলাচ্ছে না মানসিক ও পারিবারিকভাবে ‘মেয়ে’ হয়ে জন্মানোর দায়। আকতার জাহানের পরিবার তাকে বিয়ে বিচ্ছেদের মত অবশ্যম্ভাবী ঘটনাতেও সম্মতি দেয়নি, কিন্তু সেই ঘটনাই যখন ঘটলো, তখন তার বেঁচে থাকার রসদ ফুরিয়ে এসেছে। জুবেরিতে থাকাকালীন কাছে পাননি নিজ সন্তানকেও। মানসিকভাবে এতোটাই অসুস্থ ছিলেন যে সন্তান তো দূরে থাক, তিনি নিজেই নিজেকে আর টেনে নিতে পারছিলেন না। এই তীব্র একাকিত্বের মাঝে একটা মানুষের বিলীন হয়ে যাওয়াই কী স্বাভাবিক নয়?

আমি ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারের মেয়ে হিসেবে জানি সন্তান সাথে থাকলে মায়েদের একাকিত্ব খানিকটা কমে যায়। আমার মাও শুধু আমাদের কথা ভেবেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।

আমরা এ ওকে দোষারোপ করে, এ ও পরিবারের দোষ দিয়ে আকতার জাহানকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে আকতার জাহান নিশ্চয়ই কারও না কারও কাছে হাত পেতেছিলেন সাহায্যের জন্যে। কিন্তু তখন আমরা কেউ এগিয়ে যাইনি। দায় এড়িয়ে গেছি। এই যে এখন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় লিখে আমরা দোদুল্যমান অবস্থায় আছি এটাও কিন্তু একপ্রকার দায়সারা কাজ।

এর মানে এই নয় যে আমরা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জানাবো না। আমরা অবশ্যই জানাবো। কিন্তু কিছুটা হাতে রসদ নিয়ে কাজটা করলে কাজ সুষ্ঠু হবার আশা বেশি থাকে। এই যে দোদুল্যমান অবস্থা, এরই ভেতরে আরও কিছু আকতার জাহান ঝরে যাবেন নিঃশব্দে, যারা মিডিয়া কাভারেজও পাবেন না। ওদের মৃত্যু রোধ করা এখন দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। এই মৃত্যুগুলো রোধ করা এখন সময়ের দাবি। কোন আকতার জাহানের কাজের মাধ্যমে ‘মাতৃতুল্য’ হয়ে ওঠা যদি আমাদের সমাজে সাদরে গৃহীত হয়, তবে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা থেকে ‘মাতৃতুল্য’ আকতার জাহানকে মুক্তি দেয়াও সমাজে গৃহীত হবার কথা। এই কাজটাই এখন শক্ত হাতে আমাদের করতে হবে। তীব্র যাতনার মাঝে থাকা মেয়েগুলোকে বলতে হবে “চিৎকার কর মেয়ে, যতদূর গলা যায়!” আর আমরা যেন চিৎকারটা শুনে চিরবিদায়ের আগেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই।

একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। মাসচারেক আগে এক মেয়ে এসেছিল বাসায়। মেয়েটার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে ছয় বছর হলো। এক মেয়ে আছে তার। বরের অত্যাচার তুঙ্গে থাকার পরও সে কোনভাবেই বিচ্ছেদে সম্মত নয়। আমি আর মা মিলে তাকে বোঝালাম অনেক যে – জীবনটা তার, এটাকে আপন করে নেবার দায়িত্বও তার নিজেরই। কিন্তু মেয়ে কোনভাবেই বিচ্ছেদ চায় না।

আমরা তাকে বুঝিয়ে বললাম, “নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিও!” কিছুদিন পরেই শুনি মেয়ে বিচ্ছেদ মেনে নিয়ে চাকরিরত অবস্থায় ভালো আছে। এমনকি নিজ উদ্যোগে একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রস্তাবনাও নিয়েছে সে। এমনটা যেন বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে হয়। তীব্র ভাবে বাঁচার আকুতি নিয়ে যে আকতার জাহানেরা আমাদের কাছে হাত বাড়ায় তাদের কিছু দিতে না পারলেও যেন আমরা বেঁচে থাকার রসদটুকুর যোগান দেই, একটু সাহস দিয়ে বলি আমরা তাদের সাথে আছি!

আমার মনে হয়, হত্যা নাকি আত্মহত্যা এই সিদ্ধান্তে না গিয়ে আমাদের সমাজের এই নারকীয় করে তোলা পরিবেশটাকে বদলাতে হবে। একজনকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগেই আমাদের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতে হবে –  “জগতের আনন্দযজ্ঞে তোমায় নিমন্ত্রণ!”

 

শেয়ার করুন:

ভাল লেগেছে লেখাটি। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আত্মহত্যা কেউ সাধে করে না।

চারমাস আগের যে মেয়েটির কথা বললেন তিনিও হয় আত্মহত্যা করতেন না হয় তাঁকে দিয়ে করানো হত। কিংবা কোন একদিন তলপেটে লাথি খেয়ে মরতে হত।

আমাদের সমাজ কুসংস্কার দিয়ে শক্ত একটা দেয়াল তৈরি করেছে। একদিনে ভাঙা যাবে না। আঘাতের পর আঘাত করুন, আলো আসবেই।