ভালো মেয়েরা বাঁশি বাজায় না

মাকসুদা আজীজ: আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাচ্চাদের খেলনা বিষয়টা যথেষ্টই কম ছিল। তবে ছেলেদের মেয়েদের খেলনার এমন কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ভাইয়েরাও আমাদের সাথে পুতুল বা হাঁড়িপাতিল খেলতো, আমরাও দিব্যি বল, গাড়ি ঘুড়ি দিয়ে খেলতাম। তখন বাচ্চাদের চকলেট-লজেন্স বলতে দেশি লেবঞ্চুস, টিকটিকির ডিম এইসব হাবিজাবি। এখন যেমন দামি চকলেটের সাথে বাচ্চাদের ছোট একটা খেলনা দেয় আমাদের আমলে দিত বাঁশি। যেই সেই বাঁশি না। একদম পুলিশের হুইসেল। সেই বাঁশি পেয়েই আমাদের আনন্দ দেখে কে! সারাদিন হুইসেল বাজিয়ে বাজিয়ে দিন কেটে যেত।

Maksuda Aziz
মাকসুদা আজীজ

একদিন আমার মা এসে বললেন, বাঁশি বাজানো বিষয়টা খারাপ। অন্য বাচ্চা এটা মানলেও মানতে পারতো। আমার বাপ তখন ফিফার রেফারি। বাঁশি বাজানো খারাপ এটা আমাকে মানানো এতো সহজ না। শেষে আমার মা দুইটা ট্যাক্টফুল স্ট্রাটিজি নিলেন, এক, রাতে বাঁশি বাজালে সাপ আসে, দুই, মেয়ে মানুষ বাঁশি বাজালে বা চিৎকার করলে যতদূর পর্যন্ত এই চিৎকার যায়, ততদূর ফেরেশতা আসে না।

আমাদের বাসায় এক বুয়া ছিল, সে আরেক কাঠি সরেস, সে বললো, যতদূর আওয়াজ যাবে, ততদূর পর্যন্ত নাকি মেয়েদের জিভ টেনে নিয়ে এরপর পেরেক মারা হবে।

এরপরেও আমি যে বাঁশি বাজাই নাই তা না। তবে, ১৯৯৮ সালে যখন দেখলাম, টাইটানিক সিনেমার শেষ পর্যায় এসে নায়িকা বাঁশি বাজিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করলো, তখন সেটা আমাকে একটা ভালো যুক্তি দিলো। বাঁশি বাজাও, জীবন বাঁচাও।

ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত যত বড় হয়েছি, বাঁশিটা আমাকে নানানভাবে বিরক্ত করেছে। যেমন ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পরে যখন ছেলেরা অকারণে শুধু “একটা মেয়ে স্বাধীনভাবে চলে, তাকে দমাই” বা শ্বশুরবাড়িতে এসে, “নতুন বৌ, চলেন একটু খোঁচাই” কর্মসূচির পাল্লায় পড়লাম এবং বাঁশি বাজিয়ে জীবন রক্ষা করতে চাইলাম তখন বার বার আমাকে এটা শুনতে হলো, ভালো মেয়েরা ঝগড়া করে না, ভালো মেয়েরা প্রতিবাদ করে না, ভালো মেয়েরা রুখে দাঁড়ায় না, ভালো মেয়েরা ভালো হতে হতে মরে যায়, কিন্তু কিছুতেই বলে না সে খারাপ আছে।

আমাদের সমাজে ভালো মেয়ের সংজ্ঞার প্রথম দাবি হচ্ছে যার আওয়াজ পাওয়া যায় না, যে তর্ক করে না, যে গুরুজনকে অমান্য করে না, তা গুরুজন যতই লঘু ছ্যাঁচড়ামি করুক।

তো একজন আকতার জাহান জলি অত্যাচার সয়ে মরে যেতে বাধ্য হয়, তবুও তারা প্রতিবাদ করে না। এমনকি শিক্ষিত হওয়ার পরেও, নিজের আর্থিক স্বাবলম্বিতা থাকা সত্ত্বেও ভালো হওয়ার প্রেতাত্মা তার পিছু ছাড়লো না।

সম্প্রতি আমার কিছু অভিজ্ঞতা হলো।

এখানে বলে রাখা জরুরি, আমি একজন বিশিষ্ট খারাপ মেয়ে, কারণ আমি বাঁশি বাজাই। এই বাঁশি বাজানোর নাম “হুইসেল ব্লোয়িং”। আমার যখনই কোনো অস্বস্তি হয় এবং সেটার কারণ কোনো অবৈধ, বেআইনি, খারাপ কাজের জন্য হয়, আমি চোখ মুখ শক্ত করে প্রতিবাদ করি। হোক সেটা বাসের ভিড়ে কারও গুঁতা বা ফেইসবুকে কারও অশোভন আচরণ। সেটা আমার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হোক, অফিসের কলিগ, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় কী নিজের জ্ঞাতি; বাঁশি আমাকে বাজাতেই হবে।

বাঁশি বাজানোতে আমার বিশেষ রাখঢাক নাই। আমি পীড়িত হওয়ার চেয়ে খারাপ মেয়ে হওয়াটাকে বেশি পছন্দ করি। আমার বিশ্বাস, কেউ যদি খারাপ করতে পারে, তবে আমি সেটা বলতেও পারি। খারাপের জন্য একটা খারাপ খুব দরকার।  

তো আমার বাঁশি বাজানোতে দেখলাম, আমার মতোই শিক্ষিত, আমার চেয়েও অনেক প্রতিষ্ঠিত ভালো অবস্থানে থাকা কিছু মেয়ের খারাপ লাগে।

সম্প্রতি এক বন্ধু স্ট্যাটাস দিয়েই বললো যে, যারা শ্বশুরবাড়ি নিয়ে অভিযোগ করে তাদের প্রতি তার মনোভাব খারাপ। যদিও তিনি নিজে বিবাহিত নন, তাও তিনি মনে করেন এগুলো বৌদের বেয়াড়াপনা। এই পর্যন্ত তাও আমার বিষয়টা সহ্য হচ্ছিল, কিন্তু আমার আরেকজন বন্ধু যে একজন বিচারকের পদে অধিষ্ঠিত, সে সেই স্ট্যাটাসে ইচ্ছা পোষণ করলো, “কিছু মানুষকে এখানে ট্যাগ করা উচিৎ” বিষয়টা আর মানতে পারলাম না।

আমি মেনে নিলাম, আমার অবিবাহিত বন্ধু না বুঝেই একটা কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু যেই বন্ধু বিচারক, তার পেশাগত অবস্থান থেকে কী সে জানে না এই ধরনের মতামত ভিকটিমকে ব্লেম করে? এসব ব্লেম হওয়া, শেমিং করার কারণেই ভিকটিমরা কথা বলার সাহস পায় না, হুইসেল ব্লো করে না?

আরেক বন্ধু দেখলাম, খুব আফসোস নিয়ে তার কিছু অভিযোগ স্ট্যাটাসে দিয়েছে। খুব দারুণভাবে এবং সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে তার উচ্চশিক্ষিত স্বামী এবং কিছু ততোধিক উচ্চশিক্ষিত বন্ধু-বান্ধব সেখানে এসে ‘হুইসেল ব্লো’ করে এমন একজনকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছে। যাকে নিয়ে করা হচ্ছে তার একটা গুপ্তকেশেও আঁচড় দেওয়ার মুরোদ এদের নেই, শুধু ঝিকে মেরে বৌকে শিখিয়ে দিল, “বাছা মুখ বন্ধ করো, নাহলে তোমার সম্মানও এভাবে বালখিল্য হয়ে যাবে।”

অধ্যাপক কাবেরী গায়েনের লেখা ‘আকতার জাহানের সুইসাইড নোট’ (উইমেন চ্যাপ্টার, ১২ সেপ্টেম্বর,২০১৬) অধ্যায় চারের শেষ প্যারা, “এইসব বর্ণনা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো সতেরো-আঠারো শতকের কোন প্রত্যন্ত গ্রামের দাসীসম কোন নারীর জীবন-আখ্যান পড়ছি”– কথাটা আমাকে এতগুলো কথা লিখতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

সতেরো-আঠারো শতকের দাসীরা ঘরে ঘরে আছে। কারণ আজও ঘাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাদের শেখানো হয়, “ভালো মেয়েরা বাঁশি বাজায় না।” বিদ্যা আর শিক্ষা দুইটা কখনোই এক বিষয় না। কক্ষনো না।   

শেয়ার করুন: