পরদেশেই ভালো থাকুক আমার বন্ধু

(২০১৬ সালের লেখাটা আবারও নতুন করে শেয়ার করা হলো)

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী:

আমাকে ক্ষমা করিস, কৃষ্ণা। আমি সেসময় তোকে একবারও থেকে যেতে বলিনি। কয়েকদিন ধরে দেখছিলাম তুই কিছু একটা লুকাচ্ছিস। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিস না। কিছু একটা তোর ভিতরে তোলপাড় করছে।

Hindu_thereport24তুই বলছিস না বলে আমিও পীড়াপীড়ি করিনি। কিন্তু বসে থাকিনি চুপ করে। আমি তোর ভেতরের খবরটি মান্নান মাষ্টারের কাছে শুনেছি। তোরা গোপনে জমিজমা, বাড়িঘর, আসবাব বিক্রি করে দিচ্ছিস। মান্নান মাষ্টার বলেছে, তাকে মধ্যস্থতা করতে হচ্ছে ক্রেতাদের সাথে। খুব গোপনীয়তায়। কেউ যেন শেষ পর্যন্ত বুঝতে না পারে তোদের চলে যাওয়ার খবর।

তুই সে সময় আমাকেও কি বিশ্বাস করতে পারিসনি? কথাটা আজো বিশ্বাস হয় না আমার। আমিও ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছি তুই হয়তো ভেবেছিস আমি শুনলে তোকে আটকানোর চেষ্টা করবো। তুই নিজেই তো আগে বার বার তোর পরিবারকে আটকিয়েছিস। দফায় দফায় যখন এলাকার হিন্দু পরিবারগুলো বৈধ-অবৈধভাবে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছিলো, শুধু তুই তোর পরিবারকে বুঝিয়ে এপাড়েই রয়ে গেছিলি সেসময়।

তোদের গ্রামে হিন্দুরা একসময় সংখ্যালঘু ছিল না। বরং আমরা পাশের গ্রামের মুসলমানরাই তোদের চেয়ে সংখ্যালঘু ছিলাম। পুজার সময় পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতা হতো আনন্দ আয়োজনের। আমরা ভুলে যেতাম নিজেদের ধর্ম পরিচয়। এবাড়ি-ওবাড়ি দই, চিড়া,নাড়ু খাওয়া, রাতে পায়ে নুপুর বেঁধে পুজা মণ্ডপের মঞ্চে কতো আরতী করেছি তোদের সাথে। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, চৈত্র সংক্রান্তির পুজাসহ নানা ছলে  ঢাকের বাড়ি শুনলেই আর আমাকে আটকায় কে! শুধু আমি কেন, সেসময় কতো কতো মুসলমান বাড়ির বউ-বেটি পুজার বাড়িতে ঢাকের তালে নাচতাম! বয়স, ধর্ম, নারী, পুরুষ, গরীব, ধনী কোন বাধাই ছিলো না আনন্দ আয়োজনগুলোতে।

তারপর কী হতে লাগলো বুঝতে পারিনি আমি অতটুকু বয়সে। শুধু রাতে রাতে দেখলাম বাড়িগুলো ফাঁকা হতে লাগলো। চেনা আপন মুখগুলো হারিয়ে গেলো রাতের অন্ধকারে। দখল করলো দখলদাররা, প্রভাবশালী মুসলমানরা। বাড়িঘর ভেঙ্গে, গাছপালা কেটে আবাদি জমি করা হলো। ক্রমে বিলীন হলো সন্ধার উলুধ্বনি, ঢাকের বাজনা।

Leeকিছুদিনের মধ্যে আমি বুঝতে শুরু করেছি ক্রমে মানুষ কেমন সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে। হিন্দু পাড়াগুলো শ্মশানের মতো খা খা করে। সন্ধায় আর ঊলুধ্বনি হয় না। গোপনে বাজে বিদায়ের বিউগল। মুসলমানরা সংখ্যায় বাড়তে থাকে। হিন্দু বাড়ির উৎসবে-পুজায় ঢাকের বাড়ি, উলুধ্বনি, মুসলমানদের প্রার্থনা ভঙ্গ করতে শুরু করেছে! নানা ছলে হেনস্থা করা, অবিশ্বাস সন্দেহ বাড়তেই থাকলো।

তারপর তোর ছোট বোন মীরা হঠাৎ এক ভোর রাতে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল শুনলাম। আমি পরদিন তোদের বাড়িতে গিয়ে দেখি তালা, হাসপাতালে গিয়েও পেলাম না। ততক্ষণে মীরাকে তোর ওপাড়ের মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে তোরাও হুট করেই চলে গেলি। মান্নান মাষ্টারের কাছে অনেক পরে শুনেছিলাম যারা তোদের জমি কিনে নিয়েছে, চলে যাওয়ার দিন তারা একটা বড় অংকের টাকা মেরে দিয়েছে। তোরা বরং একরকম পালিয়ে গিয়েছিলি প্রাণ নিয়ে। 

আমি যে কিছুই আন্দাজ করতে পারিনি তা কিন্তু নয়, কৃষ্ণা। অনেক কিছু জেনেও আমি না জানার ভান করেছি। তোদের বাড়ির পাশের মন্দিরের জায়গা নিয়ে প্রতিবেশির সাথে বিরোধ লেগেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় তোর ছোটো বোন মীরাকে ঘর থেকে চারজন তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ভোর রাতে তাকে মন্দিরের পিছনে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। তুই আমাকে কিছুই বলিসনি কেন, কৃষ্ণা? আমি হয়তো কিছুই করতে পারতাম না এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ দখলদারদের সামনে। চিৎকার করে বলতে তো পারতাম। তারও সুযোগ দিসনি তুই।

আমাকে তুই বিশ্বাস করছিস না ভেবে কষ্ট বাড়ছিল। তখনও তোদের নিরাপত্তাহীনতার কথা আমি খুব ভাবছিলাম মনে মনে। কিন্তু কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। শেষে আমিও চেয়েছিলাম তোরা চলেই যা। তুই কি শুধু আমাকে ভুলে যেতে চেয়েছিস নাকি তোর এই জন্মভূমিকে, জানতে ইচ্ছে করে।

সেই স্কুলের মাঠ, খামার পুজা মণ্ডপের সামনের পানিয়াল গাছের ঝুলে পড়া কাঁটাযুক্ত ডাল, সেই তিনমাথা মোড়ের উঁই ঢিবির বড়ই তলা, সেই শালুক কুড়ানো চওড়ার বিল সবখানে তোর পায়ের দাগ লেগে আছে। তুইও কি ভুলতে পেরেছিস তাদের? কিছুই আর জানা হয়নি।

২৮ বছর পর তোকে খুব মনে পড়ছে, কৃষ্ণা। ভুলতে যদি পেরেছিস তো তুই হয়তো ভালোই আছিস। আমি কি খুব বেশি তোকে মনে রেখেছি এতোটা কাল! আমার বালিকা বেলার বন্ধুত্বের কসম, সত্যি বলছি, তোকে আমার মনে পড়ে যখন দেশে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করতে তাদের বাড়িঘর ভেঙ্গে দেয়া হয়, জমি-জমা কেড়ে নেয়া হয়, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, বাবার সামনে কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ঘাড় থেকে মাথা কেটে ফেলা হয়। গত কয়েকদিন থেকে তুই বার বার আমার মনে পড়ছিস। যেদিন হিন্দু পরিবারের মা ও মেয়েকে একই সাথে ট্রলারে তুলে গণধর্ষণের খবর শুনলাম, তোর সাথে আমার সকল অভিমান সেদিন জলে ধুয়ে শেষ হয়ে গেছে। তোর চলে যাওয়া, তোর না বলে যাওয়া, তোর খবর না জানানো, তোর সকল অভিমান শুদ্ধতা পেয়েছে সেদিন।

আজও বিষম খেয়ে খেয়ে তুই তোর জিব্হা দাঁতে কাটছিস কিনা জানিনা। ছোটবেলায় তো বলতিস আমি তোকে মনে করলেই তুই বিষম খাস। যেখানেই আছিস, যেন ভালো থাকিস, বন্ধু আমার।

লেখক সাংবাদিক
   

 

শেয়ার করুন: