ফারজানা শারমীন সুরভি:
“সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কোন দায় নেই। রাজনীতিবিদদের উস্কানিতে তারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে”, এই ধরনের ন্যারেটিভ মানুষ হিসেবে এবং সমাজ হিসেবে আমাদেরকে দায়মুক্তি দেয়। রাজনীতিবিদরা সহিংসতার পটভূমি তৈরি করতে পারে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি এই সহিংসতা এক্সিকিউট এবং কন্টিনিউ করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাই।
যখন জাতীয় মানসিকতা ঘৃণাবাদী হয়, তখন রাজনীতিবিদরা সেই সামষ্টিক ঘৃণাকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এখানে ঘৃণা হচ্ছে পূর্বশর্ত। যে সমাজে আমরা বড় হই, সেখানে ঘরে-বাইরে সবখানেই আমরা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি হেয়মূলক মন্তব্য শুনে শুনে বড় হই। এই ফেনোমেনাকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই! তাহলে শুধু রাজনীতিবিদদের দোষ দিয়ে লাভ কী? রাজনীতির খেলা একটি ফ্যাক্টর হতে পারে। কিন্তু তা একমাত্র ফ্যাক্টর নয়।
দুঃখজনকভাবে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এবং কর্মক্ষেত্রেও কয়েকজন সহপাঠী এবং সহকর্মীর মুখে হিন্দু-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের নিয়ে যে ধরনের ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক মন্তব্য শুনেছি, তাতে কানে আংগুল দিতে হয়। এই মানুষরা যদি পথে নেমে প্রতিমা ভাংচুর নাও করে, ব্যক্তিগত জীবনে তারা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি কতোটা রেসিস্ট আচরণ করে- তা সহজেই অনুমেয়!
“সব মুসলমান এক না”, এই আলাপ তথ্যগতভাবে হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু একজন নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিন্দুকে এই কথা বলে কোন লাভ নেই। তার ট্রমা অনুধাবন করার ক্ষমতা বাংলাদেশের একজন প্রিভিলেজপ্রাপ্ত মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়।
“কিন্তু ভারতেও মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আমেরিকাতে হেট ক্রাইমের ভিক্টিম হয় মুসলমানরা।” এই মুহূর্তে এ ধরনের তুলনামূলক আলোচনা খুব ইনসেনসিটিভ মনে হয় আমার কাছে। হ্যাঁ, সংখ্যালঘু নির্যাতন সবদেশেই কিছু না কিছু হয়। হেট ক্রাইমের ভিত্তি হলো অন্য জাতির এবং ধর্মের প্রতি মানুষের চিরন্তন ঘৃণা। একেক দেশে মাত্রাটা একেকরকম। কিন্তু যখন একজনের ঘর পুড়ে যাচ্ছে আর আপনি তাকে বলছেন- “আরে! ঘর কি তোমার একার পুড়ে! ভারতের কুদ্দুস মিয়ার ঘর-বাড়িও তো পুড়ে গেল”, তা অসংবেদনশীল আচরণ। অথবা একজন ধর্ষণের ভিক্টিমকে গিয়ে যদি আপনি বলেন- “আরে! তুমি কি একা ধর্ষণের ভিক্টিম? আমেরিকাতেও হাজার হাজার নারী রেপড হয়!”, তখন এইসব তুলনামূলক আলোচনা অন্যায়ের শিকার মানুষটির প্রতি অসংবেদনশীল আচরণ।
অনেক বাংলাদেশী মুসলমানের মধ্যে নিজের দেশের এই মাইনরিটি পারসিকিউশনের সত্যটাকে অস্বীকার করার প্রবণতা থাকে৷ এরা যখন প্রবাসী হয়, তখন তারা সে দেশের রেসিজমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং নিজেদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের জন্য কষ্ট পায়। এটাই স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু আমি বিস্মিত হই তখন, যখন দেখি যে- তারাই আবার নিজের দেশে মাইনরিটি পারসিকিউশনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। অন্যের দেশে সংখ্যালঘু হয়ে জীবন যাপনের বেদনা তারা বুঝে। পশ্চিমে সাদাদের “ওয়াইট প্রিভিলেজ” তারা বুঝে। কিন্তু তারাই আবার নিজের দেশের মাইনরিটি জনগোষ্ঠীর বেদনাকে অস্বীকার করে। নিজের দেশের “মুসলিম প্রিভিলেজ” তারা উপভোগ করে, এই সত্যকে অস্বীকার করে। ওয়াইট সুপ্রেমেসিকে ঘৃণা করে। কিন্তু মুসলিম সুপ্রেমেসিকে সমর্থন দেয়। “৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশ। তাই শরীয়া আইন চাই”, এই দাবীতে নিজের দেশে সিংহের মতো হুংকার করে। কিন্তু অন্যের দেশের বর্ণবাদী আচরণ এবং আইনের ক্ষেত্রে সরব হয়। তাদের এই বিপরীতমুখী আচরণ আমার বোধগম্য হয় না।
অনেকে বলে, মুসলমান বাংলাদেশীরাও তো অনাহারে মারা যাচ্ছে। খুন হচ্ছে। অন্যায়ের শিকার হচ্ছে। তাহলে তাদের আবার কীসের প্রিভিলেজ? এক্ষেত্রে ডিস্ক্রিমিনেশন কিংবা বৈষম্যের ধরন বোঝা জরুরী। আপনি যখন আপনার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বৈষম্য এবং সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তখন সেটা রিলিজিয়াস ডিস্ক্রিমিনেশন এবং পারসিকিউশন। আপনি যখন আপনার লিংগ পরিচয়ের কারণে বৈষম্য এবং সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তখন সেটা জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশন এবং বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা। এইখানে জাতিগত, ধর্মীয় এবং জেন্ডার পরিচয়ের কারণে মানুষকে যে বৈষম্যের শিকার হতে হয়, তার কথা বলা হচ্ছে। একেক বৈষম্যের রূপ একেকরকম। এবং সব ধরনের বৈষম্য ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা জরুরী। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, জেন্ডার এবং ভিন্ন সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের কারণে যে বৈষম্য; এর প্রতিটির চিত্র আলাদা। আলোচনা আলাদা। এর প্রতিটির প্রতিকার-ও ভিন্ন।
বুঝলাম যে, সব দেশেই মাইনরিটি পারসিকিউশন হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, সেই দেশে রাষ্ট্র এবং সচেতন জনগোষ্ঠী এব্যাপারে কী ভূমিকা পালন করছে? “আই কান্ট ব্রিদ”– জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পরে লাখ লাখ আমেরিকান এই স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করেছে। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে রাস্তা- সব স্থানে সচেতন জনগোষ্ঠী প্রতিবাদ করেছে। ওয়াইট হাউসের সামনে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা এ সংক্রান্ত পলিসি প্রোপোজাল জমা দিয়েছে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কানিমূলক প্রতিক্রিয়ার জন্য রিপাবলিকান দলের জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল। এবং অবশেষে পুলিশের ব্রুটালিটি এবং রেসিস্ট আচরণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পলিসি এবং রেগুলেশন বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশে যদি এই ধরনের প্রতিক্রিয়াগুলোও দেখতে পেতাম, তাহলে স্বদেশকে নিয়ে এতোটা হতাশা অনুভব করতাম না!
যখন আমেরিকান কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার জন্য ট্রেনিং নেই, তখন আমাদেরকে একটা বাধ্যতামূলক ‘কালচারাল কম্পিটেন্সি’ ট্রেনিং করতে হয়। সেখানে আমরা শিখি যেন, অসচেতনভাবেও আমরা রেসিস্ট আচরণ না করি। কোন শব্দটা রেসিস্ট হতে পারে, কোন আচরণটা মাইক্রো-এগ্রেশন ইত্যাদি। এই ট্রেনিং আমাকে নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতিও আরও অসাম্প্রদায়িক আচরণের শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এই ধরনের প্রশিক্ষণ কোথায়? পরিবার একটি ব্যক্তিগত ইউনিট। সেখানে না হয় বর্ণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ন্যারেটিভের চর্চা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তো আমরা মানুষকে সংবেদনশীলতার এবং অসাম্প্রদায়িক আচরণের প্রশিক্ষণ দিতে পারি। এক্ষেত্রে অল্প কিছু মানুষও যদি সচেতন হয় কিংবা অন্তত প্রকাশ্যে ঘৃণার চর্চা না করে, সেটুকুও তো একটি মানবিক রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠনের জন্য জরুরী পদক্ষেপ।
ছোটবেলাতে একটি সরকারি বিদ্যালয়ে কয়েক বছর পড়েছিলাম আমি। সেখানে কয়েকজন শিক্ষক ক্লাসে এসে সরাসরি ভয়ংকর ধরনের সাম্প্রদায়িক এবং বিশেষ করে হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটু মন্তব্য করতো। বিশেষ করে, ইসলাম ধর্ম ক্লাসে এই বিষোদগারের মাত্রাটা বেড়ে যেত। অন্য ধর্মের ছাত্রীদের জন্য আলাদা ধর্ম ক্লাস হতো না। তারা সেই ক্লাসে বসেই মাথা নিচু করে শিক্ষকদের এই সাম্প্রদায়িক আচরণ হজম করতে বাধ্য হত। আমি এখনো চিন্তা করি, না জানি কতো অপাপবিদ্ধ শিশু সেই শিক্ষকের কথায় প্রভাবিত হয়ে আজ সাম্প্রদায়িক এবং ঘৃণাবাদী মানসিকতা লালন করছে!
কয়েক বছর পরে একটি মিশনারী বিদ্যালয়ে আমি পড়ার সুযোগ পাই। সেখানে সব ধর্ম এবং জাতির মানুষকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষা পেয়েছিলাম। সেখানে হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ছাত্রীদের মাথা নিচু করে ইসলামিয়াত ক্লাসে বসে থাকতে হতো না। সব ধর্মীয় বিষয় পড়ানোর জন্য আলাদা আলাদা ক্লাসরুম এবং শিক্ষক ছিলেন। ইসলাম ধর্ম শেখানোর জন্য একজন মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ওস্তাদজী থাকতেন। তিনি আমাদের আরবিও শেখাতেন। কিন্তু আমাদের ওস্তাদজী ক্লাসে কখনো একটি সাম্প্রদায়িক বাক্যও উচ্চারণ করেন নি। সর্বোপরি, নীতিশিক্ষা নামে একটি আলাদা ক্লাস করতাম আমরা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাঠদানের ক্ষেত্রে এই স্কুলটি যে কতোটা বিপ্লবী এবং মানবিক এপ্রোচ নিয়েছিল, তা এখন চিন্তা করলে স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা হয়!
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সংঘটিত সামাজিক এবং ধর্মীয় বৈষম্য নিয়ে লেখালেখি বন্ধ করেছি অনেক আগেই। যেহেতু কিছুই বদলায় না, সেহেতু এক ধরনের হতাশাবোধ থেকে আর কিছু লিখতে ইচ্ছা করে না। এই যে গত এক ঘণ্টা ধরে এই লেখাটা লিখলাম, জানি এ-ও শুধু শব্দক্ষয় এবং সময়ের অপচয়। এর চেয়ে এই এক ঘণ্টা পড়াশোনা করলে নিজের ক্যারিয়ারের উন্নতি হতো। কিন্তু তবু লিখলাম। কারণ দিন শেষে দেশটা আমার। এই রাষ্ট্র এবং সমাজেই আমি বাস করবো। আমার প্রিয়জনরা বাস করবে। একারণে আবার একইসাথে লেখার জন্য একটা প্রবল দায় অনুভব করি। জানি, আমার এই লেখা শুধুই অরণ্যে রোদন। তবু হাল ছাড়তে ইচ্ছা করে না। কিছু না লিখলে মনে হয়, আমিও একজন অন্ধ এবং বোবা নাগরিকে পরিণত হয়েছি।