সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: সবকিছুকে যারা ধর্মীয়ভাবে বিচার করেন না তাদের কারো কারো আচরণ কখনো কখনো সেই অন্ধকারের প্রাণীদের মতোই মনে হয়। যেমন ধরা যাক সমকামিদের নিয়ে ভাবনা চিন্তা। দেখা যাবে কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল আর তেমনই কট্টর আধুনিক বা প্রগতিশীল একই ভাবনায় ডুবে আছে। বলবে যেহেতু সমলিঙ্গের যৌন সংসর্গে সন্তান জন্ম নেয় না, তাই এটি প্রকৃতি বিরুদ্ধ এবং অস্বাভাবিক। শুধু এটুকু বলেই তো ক্ষান্ত হয় না মানুষ, তারা একে অবৈধ বলে জ্ঞান করে। তাই আইন হয়, যেমনটা আমাদের দেশসহ অনেক দেশেই হয়েছে যে সমকামিতা অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কিন্তু খুব সাধারণভাবেই বুঝতে পারার কথা যে সমলিঙ্গ জীবের মধ্যে যৌন আকর্ষণ সন্তান উৎপাদনের সহায়ক না হলেও সমকামী আচরণ প্রকৃতি থেকে মুছে যায়নি। কেন যায়নি সে ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। সেই বিশ্লেষণ করার জ্ঞানও আসলে নেই আমার। শুধু কিছু প্রেক্ষাপট আলোচনা করা যেতে পারে।
একটি সমাজ এগিয়ে চলে মানবিকতাকে জায়গা দিয়ে দিয়েই। প্রায় দু’বছর আগে ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডের রাণী মরণোত্তর ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছিলেন একজন বিজ্ঞানীকে। নাম তার অ্যালান টুরিং। সমকামিতার ‘অপরাধে’ তার শাস্তি হয়েছিল ১৯৫২ সালে। তাকে দেয়া হয়েছিল যৌনতা-প্রশমনকারী ইঞ্জেকশন। হতাশায় যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন ৪১ বছর বয়সে। অনেক তাঁকে ক্ষমা করে ইংল্যান্ড বুঝিয়ে দিল, সেদিন তাকে শাস্তি দিয়ে রাষ্ট্র ঠিক কাজটি করেনি।
এমনটা আমাদের মতো দেশে ভাবা যাবে না, ভাবতে চাইও না। কিন্তু বিশ্বব্যাপীই বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর, ব্যাপকভাবে অস্বস্তিকর এক আলোচনা।
তাই বাংলাদেশের জুলহাস মান্নানের কলাবাগান আর আমেরিকার ওরল্যান্ডোর দ্যা পাল্স গে ক্লাবের মধ্যে আর কোন পার্থক্য থাকে না। দরিদ্র অনুন্নত দেশ আর উন্নত, ধনী ও শিক্ষিত মানুষের দেশ আমেরিকায় থাকা কোন কোন মানুষের মনস্তত্ব এক হয়ে যায়। সমকামিদের হত্যা করার নেশাটা একইরকম থাকে। উন্নত দেশে অটোমেটিক বন্দুকে আর দরিদ্র দেশে চাপাতির কোপে।
দুটো ঘটনার পেছনেই আছে জঙ্গিবাদ, এমনটাই বলছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার। জুলহাস মান্নানের খুনিরা ধরা পড়েনি, চিহ্ণিত হয়নি। ওরল্যান্ডোর খুনি আফগান বংশোদ্ভুত ওমর মতিন মারা গেছে ঘটনাস্থলেই।
জঙ্গি মনোভাবের কারণেই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে মতিন। জুলহাস মান্নানও সেই একই আদর্শের শিকার। তবে দুটো ঘটনাই প্রমাণ করে বিশ্বব্যাপী এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল এন্ড ট্রান্সজেন্ডার) সম্প্রদায়ের মানুষ কতটা হিংসার ভেতর বাস করে।
ঘটনার পর এখন মার্কিন গণমাধ্যমে যেসব বিশ্লেষণ পাওয়া যাচ্ছে সেসবে জঙ্গি মনোভাবাপন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের নব উত্থানের কথাই বেশি আলোচিত হচ্ছে। তবে অনেক মাধ্যম এও বলছে যে, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের প্রতি, বিশেষ করে সমকামীদের প্রতি, ঘৃণা আর হিংসার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। বিশ্বের যেখানে যেখানে তাদের উপস্থিতি সেখানেই কোন না কোন ঘটনা ঘটছে বা হুমকি আসছে।
আটলান্টায় ১৯৯৬ সালে লেসবিয়ান পানশালা আর এবরশন ক্লিনিকে হামলার কথা স্মরণ করছে মার্কিন গণমাধ্যম, যেমন করে স্মরণ করছে ১৯৭৭ সালে আটলান্টায় দ্যা আদারসাইড নামের এক নারী সমকামিদের বারে বোমা হামলাকেও। এরিক লুডল্ফ নামের সেই হামলাকারী মুসলিম জঙ্গি ছিল না। আদালতে সে বলেছিল, তার প্রচণ্ড ঘৃণা সমকামীদের প্রতি।
মুসাব ম্যাসমারি নামের আরো একজন ধরা পড়ে পুলিশের হাতে ২০১৩ সালে। এই লোক সে বছর নববর্ষের ঠিক আগে আগে সিয়াটলে একটি গে নাইট ক্লাবে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আদালতের রায়ে তার ১০ বছর জেল হয়। আইনজীবীরা মামলা চলার সময় তার যে বক্তব্য নেয় সেখানে সে বলে, “আগুন দিয়েছি গে ক্লাবে, কারণ এসব ব্যক্তি যা করে তা ভুল”। ডালাসে গে ক্লাব ও বারে হামলা নিয়মিত ঘটনা। সিয়াটলের ঘটনার সময়টাতে ডালাসে তিনটি গে বারে হামলা হয়, তছনছ করা হয়।
বহু বছর ধরেই এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষজন বিশ্বের নানা প্রান্তে হামলা ও ঘৃণার শিকার হচ্ছে। অনুন্নত দেশে যেমন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের গণমাধ্যমও বিষয়টিকে কম গুরুত্বের সাথে দেখেছে। এ সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার নিয়ে যত সভা সেমিনার হয়, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি ততই উপেক্ষিত থাকে। এরা সমাজের কাউকে ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে ক্ষতি করে না, কিন্তু নিয়মিত এরা সন্ত্রাস আর গোয়ার্তুমির শিকার হয়।
সমকামিদের বিয়ে করার অনুমোদন দেয়া হলেও সমাজে বিরাজমান হোমোফোবিয়া নামের ঘৃণা থেকে এদের পরিত্রাণ নেই। ওমর মতিনের বাবা বলছে, মিয়ামিতে দু’জন যুবককে চুমু খেতে দেখে তার ছেলে ক্ষুব্ধ হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এক ভয়ংকর হোমোফোবিয়া!
আমরা জানি বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর মধ্যে যৌন আকর্ষণ স্বাভাবিক। কিন্তু সমলিঙ্গের মাঝে এই আকর্ষণ একেবার অস্বাভাবিক নয় বলেই যুক্তি উঠছে উন্নত বিশ্বে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ শুধু নয় অন্য প্রাণীর সংসারেও সমলিঙ্গের সদস্যদের মধ্যে যৌন আকর্ষণ কাজ করে।
ডলফিন, পেঙ্গুইন, ব্যাঙ, সাপ, কেঁচো, ভেড়া এবং বহু পোকার জগতে সমকামিতা প্রায় স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। বিজ্ঞানীরা এও বলেন যে পুরুষদের জননেন্দ্রিয়ের গঠন এমন ধরনের যে তা সমকামী আচরণকে প্রশ্রয় দেয়।
নিয়মবিরুদ্ধ যদি নাও বলি তবুও সমকামিতা মানুষের কাছে এক অদ্ভূত বিষয়, কেমন যেন ধাঁধার মতো। প্রাণীর বংশবৃদ্ধি সবার কাম্য। সমকামিতা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় ঠিক এখানে। সমলিঙ্গের জীবের মধ্যে যৌন আকর্ষণ সন্তান উৎপাদনের সহায়ক নয়। এই বাস্তবতায় সমকামী আচরণ প্রকৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। সেই প্রশ্নের সমাধান হয়নি বলেই উন্নত সমাজে সমকামীসহ সামগ্রিকভাবে এলজিবিটি অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে।
ভারতে কিছুদিন আগে মৌলবাদি সংগঠন আরএসএস-এর যুগ্ম সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবাল বলেছিলেন, যতক্ষণ না অন্য কারও জীবনে কোনও সমস্যা তৈরি করছে ততক্ষণ সমকামিতাকে অপরাধ বলে গণ্য করা যায় কিনা ভাবা দরকার। তিনি বলেছিলেন, যৌন পছন্দ একেবারেই কারও ব্যক্তিগত বিষয়।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ তো দূরের কথা, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই যে বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা আজও প্রশ্নের মুখে তার প্রমাণ একের পর এক ঘটনা। সমকামিদের মিলনস্থলে হামলা, হত্যা প্রমাণ করে সমানের পথ আরো বন্ধুর।
পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন