কাকলী তালুকদার: ঘুমের ঘোরে দেখলাম পুষ্পবতী আমাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছে। একটা সাদা খাম হাতে দিয়ে বললো, ‘তুমি কিন্তু আইবা’। হুট করে ঘুম ভেঙে গেলো,পাশে থাকা মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করে যা শুনলাম আর এইমাত্র পুষ্পবতীর নিমন্ত্রণপত্র মিলে আমি এক ধাঁধায় পরে গেলাম। এটাও কি সম্ভব?
দশ মিনিট হলো পুষ্পবতী মারা গেছে! অথচ দশ মিনিট আগেই পুষ্পবতী আমাকে সাদা খামে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলো। ঘোর নিয়ে বসে আছি, আর পুষ্পবতীর সাথে আমার সকল স্মৃতি ঘুরে ঘুরে চোখের সামনে ভেসে আসছে। চোখের কোনে এক বিন্দু জল আটকে আছে আমার। দ্বিতীয় ফোঁটা জলের অভাবে প্রথম ফোঁটাটি চোখের কোনেই আটকে থাকলো।
শেষ যখন পুষ্পবতীর সাথে আমার দেখা হলো, তখন দাঁতহীন মুখে হাসি দিয়ে আমাকে বলেছিল, ‘আমার বাবা আমার কুষ্টি করে গেছে, ৮০ বছরে আমার একটা বিপদ আছে, যদি এই বিপদ কাটিয়ে উঠি, তবে আমার আয়ু ৯৫ বছর’।
পুষ্পবতীর সাথে আমার সম্পর্কের শুরু ২০০২ সাল থেকে।
তখন পুষ্পবতীর বয়স ৭০ বছর। বেশির ভাগ সাদা হয়ে যাওয়া চুলের সিঁথিতে লাল সিঁদুর। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের পুষ্পবতী নীল রঙের চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়ী পরে ছিল। ৭০ বছর বয়সেও তার পরিপাটি চুল, পরিচ্ছন্ন নীল শাড়ী আর কপালের সিঁদুর আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তার চেয়েও মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং ছোট সুরে তার গল্প বলার ধরন।
পুষ্পবতীর সাথে আমার প্রায়শঃই দেখা হতে থাকলো, সাথে গল্পের ফুলঝুরি। তাঁর একই গল্প আমি অনেক বার শুনেছি, আমার ক্লান্তি লাগতো না। আমি বুঝেছিলাম, পুষ্পবতীর সোনালী সময়গুলো ছিল তার বিয়ের আগেই, যখন সে তার বাবার বাড়িতে ছিল। সেই সুন্দর সময়টি তার মানসিক গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখলেও সময়টি ছিল খুব অল্প।
১৬ বছর বয়সে পুষ্পর বিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই থেকে পুষ্প’র জীবনের গল্পগুলোও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পুষ্প’র আমিত্ব ছিল এক অসাধারণ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
পুষ্পবতীর কাছে সুভাষ বসু, জওহরলাল নেহেরু আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। তাঁর যখন ৬/৭ বছর বয়স তখন সুভাষ বসুকে মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন নিজ হাতে। সেই গল্প শুনে তাঁকে আমি ছুঁয়ে দেখেছিলাম। যেন আমি সেই সকল বিখ্যাত মানুষকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য পেলাম।
পৌষ মাসের দুই তারিখ পুষ্পবতীর জন্ম। প্রতিবছর তাঁর বয়স সে গুণে রাখতো। সে জানে আশি বছরে তাঁর একটা বড় বিপদ আছে। এক সময় আমি ঢাকায় চলে আসলে পুষ্পবতীর সাথে কম দেখা হতো। কিন্তু যখনই নেত্রকোনায় যেতাম পুষ্পবতীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করতাম। আমরা দুজনই দুজনকে দেখলে খুব আনন্দিত হতাম।
পুষ্পবতীর বিয়ে হলো ভাটি অঞ্চলের বড় কৃষক বাড়িতে। পাকা ঘর বাড়ি, দুর্গা মন্দিরসহ হাজার মন ধান দেখে পুষ্পবতীকে তাঁর বাবা এই ঘরে বিয়ে দিয়েছিল। আমার সাথে পুষ্পবতীর যখন কথা হচ্ছিল তাঁর বয়স তখন ৭২ থেকে বেড়ে ৭৫। কিন্তু এই বিয়ে আমি মানতে পারছিলাম না! বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম, কেন তোমার বাবা এখানে তোমাকে বিয়ে দিলো? যেন এই মুহূর্তে সম্ভব হলে পুষ্পবতীর বিয়ে, এই সংসার আমি নতুন করে অন্য কোথাও দিয়ে দিতাম। পুষ্পবতীকে খুব কম সময়ই আমি মন খারাপ হতে দেখেছি।
গল্পগুলো বলার সময় তার চোখে সেই সময়গুলোকে আমি দেখতে পেতাম। নতুন বিয়ে হওয়া পুষ্প রাতে স্বামীকে একটা গোপন কথা বলেছিল। পরদিন সেই কথা সবার মুখে মুখে ঘুরছিল, সেদিনই পুষ্প সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর কোনোদিন স্বামীর কাছে গোপন কথা বলবে না।
পুষ্পবতী ৭৮ বছর বয়সে বিধবা হয়েছে, হাতে শাঁখা, মাথায় সিঁদুর যে মানুষটির জন্য তার কাছে আর গোপন কথা বলেনি কোনদিন। শহরের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে জন্ম তাঁর, জীবনের ১৫ বছর কাটিয়েছে সেই বাবার কোয়ার্টারে সিলেটের ছাতকে। তারপর ভাগ্য তাঁকে নিয়ে এলো বিচ্ছিন্ন এক গ্রামে।
বিয়ের পর পুষ্পের ঘরে এক ছেলে সন্তানের জন্ম হয়, তার পরের বছর আরেক ছেলের। পুষ্প একদিন স্বামীকে ডেকে বললো, আমি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেতে চাই। দুই ছেলে হয়েছে, আর তো সন্তানের দরকার নেই।
মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে তাঁর স্বামী উত্তর দিলো, এই গুলা বেশ্যা-মাগিরার কাম, বড়ি খাওয়ার দরকার নাই। পুষ্প গোপনে চোখের জল ফেলেছে বহুবার আর তাঁর শুধু বাবার মুখ মনে পড়তো।
যেদিন সুভাষ বসু সিলেটের ছাতকে এসেছিলেন তাঁর বাবাই মালা দিতে নিয়ে গেলেন। সেই বাবাই আবার এই ঘরে এসে মেয়ের বিয়ে দিয়ে গেলেন! পুষ্প আমার কাছে হাসি মুখ করেই বলতে থাকলো, এর পর আমি কুত্তা-বিলাইয়ের মতো সন্তান জন্ম দিতে থাকলাম। মোট ১৪ জন সন্তানের জন্ম দিলো পুষ্প। ১০ জন শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিল। সেই দশ সন্তানের কেউই পুষ্প’র মতো হয়নি, এই দুঃখ পুস্পর মাঝে আমি কখনও দেখিনি, কিন্তু আমি যেন এই শোক মানতে পারিনি কোনদিন।
যদিও পুষ্প’র দুই ছেলে ৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে ছিল, কিন্তু পুষ্প’র জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে অনাদরে। আদরে বড় হওয়া পুষ্প দশ সন্তানের ভাগ-বাটোয়ারার মধ্যে বোঝা হিসেবেই শেষ সময়গুলো কাটিয়েছে। আমার সাথে যখন শেষ দেখা হলো, সাদা মলিন একটা কাপড় পরনে। কোনভাবেই এক কালের রাজকন্যার শরীরের সাথে এই মলিন কাপড়টা মানাচ্ছিল না।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, পুষ্পবতী, তোমার মরে যেতে ইচ্ছে করে কখনও? মলিন মুখে হাসি টেনে বলেছিল, ‘মরতাম ক্যারে? জীবন তো একটাই, দেহি, আরও দেইখা মরতে চাই’।
আমি বললাম, তোমার যে এখন কষ্ট হয় পুষ্পবতী, তুমি যে রাজকন্যা ছিলে।
পুষ্প হেসে বলে, জীবন তো এমনই। মরলে কি জীবনের স্বাদ পাওয়া যাবে! সেই পুষ্পবতী যখন পৃথিবী ছাড়লো, আমি তন্দ্রায় তাঁর হাত থেকে সাদা খামের নিমন্ত্রণ পত্রটা নিচ্ছিলাম।
একদিন পুষ্পবতীকে বলেছিলাম, তুমি যদি আবার পৃথিবীতে আসো, আমার পেটে জেনো তোমার জন্ম হয়। সেই নিমন্ত্রণপত্র পুষ্প ঠিকই আমার হাতে দিয়ে গিয়েছে জ্যৈষ্ঠ মাসের এক দুপুরবেলা, তখন আমার এখানে মধ্য রাত। পুষ্পবতী আমার ছায়া কন্যা, হেঁটে বেড়ায় আমার চারপাশে, আমি তার অস্তিত্ব টের পাই।
১১জুন ২০১৬