শান্তা মারিয়া: একটি মেয়ে কাঁদছে। তার হাতে ধারালো ছুরি। সে সেই ছুরি দিয়ে নানাভাবে নিজেকে আঘাত করছে। চেষ্টা করছে মরে যাবার। কিন্তু মৃত্যু হয় এমন তীব্র আঘাত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কারণ মানুষের সহজাত বোধ তাকে বলছে বেঁচে থাকতে। না, কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়। এ দৃশ্য সত্যিই জীবন থেকে নেয়া।
সদ্য প্রয়াত মডেল সাবিরা হোসেনের আত্মহত্যার চেষ্টা করার ভিডিওটি ফেইসবুকে, ইউটিউবে অনেকেই দেখেছেন। ভিডিওতে সাবিরা বারে বারে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল, তার কষ্টের কথা। যে ‘বাচ্চা মেয়ে’টি একটু কেটে গেলে ব্যথায় অস্থির হয়ে যেত, কাঁদতো, সে ছুরি দিয়ে নিজের জীবন শেষ করার চেষ্টা করছে। প্রেমিকের অবিচার, প্রেমিকের ছোটভাইযের দুর্ব্যবহারের কথা শোনা গেছে তার মুখে। নিজেই ফেইসবুকে ভিডিওটি পোস্ট করেন সাবিরা। সেই ভিডিওতে তাকে মরতে দেখা যায়নি। এই ভিডিও দেখার পরও তার পাশে দাঁড়ায়নি আত্মীয়, বন্ধুরা। তার সেই প্রেমিকও ছুটে যায়নি তাকে বাঁচাতে। মঙ্গলবার ২৪ মে তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
সাবিরার অভিযোগ ছিল, প্রেমিক নির্ঝর সিনহা রওনক তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। কিন্তু বিয়ে করতে চায়নি তাকে এবং প্রেমিকের ছোটভাই তাকে অকথ্য গালাগাল করেছে। পুলিশ জানায়, নির্ঝরের ফোন পেয়েই তারা সাবিরার ফ্ল্যাটে যান। প্রশ্ন উঠতে পারে নির্ঝর কিভাবে জানলেন সাবিরা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন? নির্ঝরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হয়তো দেখা যাবে, সাবিরা মৃত্যুর আগে ফোন করেছিলেন তাকে। নির্ঝরই তাকে হত্যা করেছেন, না সাবিরা আত্মহত্যা করেছেন সেটিও হয়তো তদন্তের পর জানা যাবে।
কিংবা প্রকৃত ঘটনা আর কখনও নাও জানা যেতে পারে। ‘তনু হত্যা’সহ আরও অনেক ঘটনার মতো সাবিরার মৃত্যুর ফাইলটিও হয়তো ধামা চাপা পড়ে যাবে অন্য অনেক নতুন কোনো ঘটনার ভিড়ে।
যদি ধরে নেই সাবিরা আত্মহত্যা করেছেন তাহলে বলতে হয়, সাবিরা হোসেন নামের অভিমানী মেয়েটি জানতো না, জীবন, ভালোবাসা, সমাজ কত নিষ্ঠুর হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা তার জানা ছিল না, পুরুষের কাছে চোখের জল, অভিমান, প্রেম–এ সবের কোনটিরই কোনো মূল্য নেই। হায় মেয়ে, তুমি বোঝোনি তোমার মৃত্যু নিয়ে মিডিয়ায ব্যবসা হবে, তোমার চোখের জল বিক্রি হবে, তোমার অভিমানের মূল্যে রমরমা আসর জমাবে অনলাইন পত্রিকাগুলো কিন্তু তোমার আদিগন্ত অভিমান কেউ বুঝবে না। মনে পড়ে যায় বলিউডের অভিনয়শিল্পী জিয়া খানের মৃত্যুর কথা। জিয়া খানও ছিলেন তার প্রেমিক সুরজ পাঞ্চোলির চরম নির্যাতনের শিকার্।
প্রেম নামক একটি অবান্তর সম্পর্ককে কেন্দ্র করে অনেক নারী নিজের জীবনের ইতি ঘটান। ‘আন্না কারেনিনা’ উপন্যাসের নায়িকা আন্নার মতো তারা মনে করেন, তাদের মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের প্রেমিকের অবিচারের প্রতিশোধ নেওয়া যাবে। তাদের ধারণা মৃত্যুসংবাদ শোনার পর দুঃখে, কষ্টে, অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে তাদের প্রেমিকরা একেবারে ভেঙে পড়বে। তাদের বুক ফেটে যাবে। তাদের জীবনের সব সুখ শেষ হয়ে যাবে। তারা প্রেমিকার শোকে দিনরাত কান্নাকাটি করবে।
এই বোকা মেয়েরা জানে না তাদের মৃত্যুর পর প্রেমিকরা অশ্বডিম্ব প্রসব ছাড়া আর কিছুই করবে না। তারা কান্নাকাটিও করবে না, অনুশোচনাও করবে না। বরং নতুন একটি বোকা-শিকার খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। ইউটিউবে সাবিরার ভিডিওটি অনেকেই যেমন দেখেছেন তামাশা দেখার মনোভাব নিয়ে, তেমনি ধান্দাবাজ পুরুষদের কাছে প্রেমিকার আত্মহত্যা এক ধরনের তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। প্রেমের ছুতায় যে পুরুষের ধান্দা শুধু শারিরীক সম্পর্ক গড়ার, নারীরও উচিত ওই পুরুষটিকে টিসু পেপারের মতো ব্যবহার করার পর ঘৃণায় তাকে ত্যাগ করা।
কিন্তু মেয়েরা মূলত বোকা। তারা আবেগে ভেসে যায় এবং পুরুষরা সেই আবেগের সুযোগ গ্রহণ করে। ‘ভার্জিনিটি’, ‘চেস্টিটি’ ইত্যাদি কতগুলো পুরুষতান্ত্রিক শব্দমালা ও ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে নারী মনে করে শারীরিক সম্পর্ক যেহেতু হয়েছে সুতরাং সে ‘ব্যবহৃত’ হয়েছে। এখন বিয়েই তার গন্তব্য। সময় এসেছে এইসব জঞ্জালমার্কা চিন্তা ছুঁড়ে ফেলার। সাবিরা নিজেই তো বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ত্যাগ করতে পারতো নির্ঝরকে। যে লোক প্রেমিকার বিষয়ে আগ্রহী নয় তাকে সবলে ও ঘৃণায় ত্যাগ করা উচিত নারীরই। দায়িত্বহীন, নিষ্ঠুর কোনো পুরুষকে বিয়ে করে খামোখা সংসার নামক যাঁতায় পিষ্ট হওয়ার দরকারটা কী?
শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে বলেই ক্যারিয়ার ফেলে বিয়ে করতে হবে- নারীর এমন সেকেলে ধারণাই তাকে ঠেলে দেয় আত্মহত্যার মতো হঠকারিতার পথে।
আরেকটি কথা, আত্মহত্যা প্রমাণিত হলে, এত ডামাডোলের ভিতর সাবিরার প্রেমিক ও তার ভাই ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা’র শাস্তি থেকে যেন রেহাই না পায় সে দাবির কথা ভুললে চলবে না কোনোভাবেই।