নারীর কোথাও কেউ নেই

সেলিনা শিউলী: তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় সামিনা। ছয় বছর আগে বিয়ে হয় তার। শ্যামলা গায়ের রঙ। দাঁত উঁচু, দেখতে ভাল না, এমন অজুহাতে তার বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিল বারবার। গাঁয়ের লোকেরা বলতো, ‘মাইয়াডা কালা, দেখতে হুনতেও বালা না, ওরে বিয়া করব কেডা’? শিক্ষক বাবার আড়ালে মা ও আত্মীয়রা বলেন, মাইয়া মানুষ, অতো লেহাপড়া করাইয়া কী অইবো? বিয়া দিয়া দেওনই বালা’।

উচ্চ মাধ্যমিক আর শেষ করা হয় না। আত্মীয় পরিজনের পরামর্শে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন অভিভাবক। ঘটক মেয়ের বাপকে পরামর্শ দেন, ‘পাত্র ঘর-গেরস্থালী করে। লেখাপড়া বিশেষ কিছু করে নাই। বাপের জমিতে হালচাষ কইরা বড় হইছে। ছেলে মানুষের আবার যোগ্যতা লাগে নাকি। এমন পাত্র হাতছাড়া করা ঠিক না। এই সম্বন্ধটা করো। যৌতুক দেওনতো লাগবই, মাইয়ার সুখের লাইগা কিছু দিছ এমন মনে কইরা খরচ করো।’

Frida Kahloমেয়ের গয়না, ঘর সাজানোসহ অতিথি আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে শুভদিন দেখে সামিনার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের দিন থেকেই নিজের শরীরটাকে একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না সে। স্বামী সোহাগ কি; তা  কল্পনাতেই শেষ হয়। মুরব্বীদের উপদেশ মনে পড়ে। স্বামীর বাড়ি গেলে সহ্য করতে হয়, সবার কথা মুখ বুজে শুনতে হয়। স্বামীর সঙ্গে অশান্তি করা ভাল নয়-কথাটা মাথায় রাখে সে।

মাঠের কামলাসহ দুই হালি মানুষের সংসারে সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে শরীরটাকে দিতে হয় স্বামীর জিম্মায়। নিজের ইচ্ছার কোন মূল্য নেই এখানে। ব্যাথায় চোখ গড়িয়ে নামে জল। বছর ঘুরতেই কোলে কন্যা সন্তান। স্বামীর কপালে চিন্তার রেখা। প্রতিবেশীরা ফিসফিসিয়ে বলে,’মাইয়া জন্ম দিছে,এই বউটা অপয়া’। শাশুড়ি ভাবে আবার কন্যা সন্তান হলে, ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে করাবে। স্বামী ফুঁসে ওঠে, ‘তোর দোষে মাইয়া হইছে’। এইবার পোলা না বিয়াইলে কপালে অলক্ষ্মী আছে। বছরের মাথায় আবার গর্ভবতী হয় সে। সামিনার নীরবে প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তার প্রতি, এবার মুখ তুলো, পোলার চেহারা দেখাইয়ো’। সৃষ্টিকর্তা মুখ তোলেন, ছেলের কান্না তার মনে আনে সংসার বাচাঁনোর সুখ। এভাবেই চলে সামিনার সংসার নানা অভাব আর অবহেলায়।

হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ওর স্বামী হাট থেকে এসে রাগত স্বরে বলে, তোর বাপ শিক্ষিত মানুষ, হেয় নিকা করছে। আমি তো মুর্খ মানুষ। আমার কয়টা নিকা করা লাগে ক দেহি’। তোর বাপের মান সম্মান নাই। আমাগো আছে’। যেই বাপ নিকা করে, হের মাইয়া লইয়া আমি সংসার করুম না। তোরে তালাক দিলাম আমি। এই বলে চুলের মুঠি ধরে পিটিয়ে জোর করে দুই সন্তানসহ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সামিনাকে।

এবারও সামিনা নীরব। নিজেকে অভিসম্পাত করে। কী করে সে জীবনের অবশিষ্ট সময় কাটাবে? সামনে অন্ধকার। মা কিছু বলে না। কিন্তু ভাবে তার অন্য মেয়েটির কথা। তাকে বিয়ে দিতে হবে। ঘরে সোমত্ত মেয়ে তালাকপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসেছে। দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে উপরের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কারো সঙ্গে কী যেন কথা বলে নীরবে।

 

শেয়ার করুন: