আমার যে কন্যা সন্তানটি জন্ম নেবার কথা ছিলো, তার প্রতি…

শাহাদাত রাসএল: আমার প্রতি তোর অনেক অভিমান জানি, হয়তো ঘৃণাও করিস

আমিও নিজেকে ঘৃণা করি

কারণ যে বাবা তোকে জন্মের আগেই তোর মায়ের পেটের ভেতরেই হত্যা করেছিলো

সেই বাবাকে কি ঘৃণা না করে পারা যায় বল?

অবশ্য এতে তোর মা আর আমার দুজনারই সম্মতি ছিলো

আচ্ছা, আমি যে ‘বাবা মা’ বলছি তুই কি বুঝতে পারিস ‘বাবা মা’ কাকে বলে?

আমি তো তোকে বাবা মা চেনার সময়টুকুও দেইনি

জানিস যখন তোর মা আর আমি বিয়ে করি তারপর থেকে সন্তান নিয়ে আমাদের কতশত পরিকল্পনা…

তোর মা চাইতো ছেলে হোক

আমার এক কথা ‘আমার একটা রাজকন্যা চাই’

তারপর ঝগড়া থামিয়ে দুজনেই বলতাম ‘দেখে নিও আমার ইচ্ছেই পূরণ হবে’

আমার ইচ্ছেটাই পূরণ হয়েছিলো রে..

তুই এসেছিলি…

ডাক্তার যেদিন বললো ‘আপনাদের মেয়ে হবে’

তোর মা সেদিন মুখভার করে বললো, ‘যাও এবার তুমিই জিতে গেলে..’

তারপর তোর মা আমার বুকে লেপ্টে থেকে কতক্ষণ কাঁদলো

তুই যদি সেদিন তোর মায়ের কান্না দেখতি তবে বুঝতি

মানুষ তীব্র সুখে কীভাবে কাঁদে, আমিও কেঁদেছিলাম।

তুই যখন একটু একটু করে শরীর নিয়ে তৈরি হচ্ছিলি তোর মায়ের পেটে

তখন একরাতে আমদের পাশের বাড়ির নরেশ দাদার ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়েটাকে

তুলে নিয়ে গেলো সাতজন

সারারাত গায়ে সংখ্যালঘু সিল মারা মেয়েটাকে ধর্ষণ করে সাতজন সংখ্যাগুরু

অবশ্য মেয়েটাকে ওরা ভোর রাতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায়

নিরাপদে নরেশ দাদার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো

মেয়েটা বেঁচেছিলো সেটাই ছিলো নরেশ দাদার সান্তনা।

তুই তো জানিস না, এইদেশে নারীর চেয়ে সংখ্যালঘু আর কেউ নেই…

তোর মা সেদিন ফ্যালফ্যাল করে নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে ছিলো..

Rasel
শাহাদাত রাসএল

তুই কি আমার কথাগুলো শুনতে পাবি? জানিনা।

তবুও খুব ইচ্ছে করছে তোকে বলতে..

 

আমাদের গ্রামের আরেকটা মেয়ে শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধে বাড়ি ফিরছিলো,

অনেকদিন সে মায়ের হাতের রান্না খায়নি।

মাকে বলেছিলো “আমি আসছি, পছন্দের সব তরকারী রান্না করা চাই, এসেই পেট ভরে খাবো’

মেয়েটা বাড়ি এসে মায়ের হাতের রান্না খাবার আগে সে নিজেই পরিণত হয়েছিলো শিয়াল কুকুরের খাদ্যে

সারারাত রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত ঘরে তিনজন সরকারি লোক…….

সকালে রেললাইনে পড়েছিলো মেয়েটার ছিন্নভিন্ন ন্যাংটা মৃতদেহটা..

সরকার তার ইমেজ বাঁচাতে

দেশের সকল পোষমানা মিডিয়ায় প্রচার করে দিলো ‘মেয়েটি বেশ্যা ছিলো’

এই নিউজটা পড়তে পড়তে প্রথম তোর মা পেটের উপর হাত রেখে চিৎকার করে উঠেছিলো, আতংকে..

শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?

মেয়ে হত্যার প্রতিবাদ করায়, নিজের আদরের শান্ত মেয়েটাকে বেশ্যা বলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায়

আরো চড়া মাশুল দিতে হয়েছিলো মেয়েটির মাকে

যেই মা মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করে বারবার উঠানের দিকে তাকাচ্ছিলো মেয়ের প্রতীক্ষায়..

মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবী করায় সেই মাকে একরাতে তার নিজের ঘরে মুখ চেপে ধরে চারজন,

অস্ত্রের মুখে স্বামী আর কলেজ পড়ুয়া ছেলের সামনে সেই মাকে ধর্ষণ করা হয়।

কেবল ধর্ষণ নয় ছেলে আর স্বামীর সামনে নিহত মেয়েটির মায়ের মুখে পালাক্রমে ঢুকিয়ে দেয়া হয় ক্ষমতার পুরুষাঙ্গ..

শুনতে পাচ্ছিস তুই?

খুব মিথ্যে মনে হচ্ছে তোর?

কিচ্ছুটি বানিয়ে বলছিনারে..

এটাই আমাদের দেশ…

এখানে সকালের চায়ের সাথে আমরা পত্রিকার পাতা থেকে তুলে এমন দশ বিশটা খবর নির্লিপ্তভাবে গিলে ফেলে দিন শুরু করি..

যে মেয়েদের কথা বললাম তাদেরও তো বাবা ছিলো,

আমার মতোই খুব সাদামাটা আর খুব অসহায় বাবা..

তবে আমি কি করে তোকে দেই এমন অন্ধকার ভবিষ্যৎ ?

আমি খুব বেশি সাদামাটা রে..

আমাদের কোন সুপার পাওয়ার নেই

যাদের কোন বিশেষ ক্ষমতা নেই, তাদের যে রাজকন্যা জন্ম দেয়া পাপ..

কী করে রক্ষা করতাম তোকে?

এই নষ্ট পৃথিবীর কুৎসিত মুখ তোকে দেখাতে চাইনি…

তাই তোর মা আর আমি মিলে তোকে……

অন্যথায় আমার এতো আদর আর স্বপ্নের রাজকন্যার মৃতদেহ আমি কোথায় রাখতাম বল?

শুনতে পাচ্ছিস তুই?

আমি তোর বাবা বলছি….

শেয়ার করুন: