টিউলিপ সিদ্দিকের আওয়াজ যেন ঘুম ভাঙায়

Tulip 2ফারহানা হাফিজ: মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং সুবিধা প্রদান প্রসঙ্গে প্রাচ্যের বেশীরভাগ দেশে তো বটেই, পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও দেখছি একইধরনের নেতিবাচক একটি ধারণা বিরাজমান যে এ ধরনের সুবিধা দেয়ার সাথে নারীর কর্মক্ষমতা কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এবং অনেকক্ষত্রে কোন কোন নারীও এটা ভাবতে থাকে বা ভাবতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত টিউলিপ সিদ্দিকের মাতৃত্বকালীন সময়ে সংসদে অনুপস্থিতি নিয়ে স্পিকারের দেয়া নেতিবাচক বক্তব্য এবং তার ফলশ্রুতিতে টিউলিপ সিদ্দিকের উত্থাপিত প্রস্তাব প্রসঙ্গেই আজকের এই লেখা। ঘটনাটি ব্রিটেনের হলেও, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে অনেক নারীকে প্রায়শই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এবং একটি দোটানার মধ্যে নারীকে থাকতে হয়, ক্যারিয়ার না কি সন্তান? অধিকাংশ ক্ষেত্রে লড়াইয়ের এক পর্যায়ে রণে ভঙ্গ দিতে হয় চাকরিজীবী মাকে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

পৃথিবীব্যাপী নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আওয়াজ যেমন সুসংহত হচ্ছে, পাশাপাশি দেখতে পাচ্ছি মাতৃত্বকালীন সময়ে নারীর জন্য কী সুবিধা থাকা উচিত সে প্রসঙ্গে একটি উল্টোমুখী সনাতন চিন্তাধারাও রাষ্ট্রে ও সমাজে বিরাজমান।

বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ একটি জনপ্রিয় শব্দ হিসেবেই আজকাল উচ্চারিত হতে শুনি,  তা যেমন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, তেমনি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবে নারীর জন্য কতটা ক্ষমতায়নমুখী  চিন্তাভাবনার প্রতিফলন আমরা দেখি, তার একটি বাস্তব উদাহরণ হতে পারে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য মাতৃত্ত্বকালীন সুবিধার নীতিমালা ও তার প্রয়োগ বিষয়টি।

১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন যখন সমগ্র পৃথিবীতেই একটি আওয়াজ তুলেছিল একটি শ্লোগান দিয়ে, ” নারীর চোখে বিশ্ব দেখি”, তার একটি ইতিবাচক প্রভাব তখন বাংলাদেশেও পড়েছিল।

বেইজিং সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে আমরা সরকারিভাবে ১৯৯৭ সালে প্রথম একটি “জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা” পাই। এই নীতিমালার ভিত্তিতে মাতৃত্বকালীন নারীর জন্য সুবিধা, বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

এখানে বলে রাখছি ১৯৯৭ এর পূর্বেও মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু নীতিগতভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে এই নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে। শুরুতে তিনমাস, পরবর্তীতে চারমাস হয়ে বর্তমানে সরকারিভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটির সময়সীমা ছয়মাস। তারপরও একটা অস্পষ্টতা রয়েই গেছে, প্রথমত এটি কি শুধুই সরকারী চাকুরেদের জন্য, না কি সরকারের দেখভালের আওতায় দেশের সকল কর্মক্ষেত্রের জন্য? দ্বিতীয়ত, মাতৃত্বকালীন অন্যান্য সুবিধা কেমন হবে?

এই অস্পষ্টতার একটি প্রধান কারণ হলো আমরা মাতৃত্বকালীন ও তার পরবর্তী অবস্থাকে সামাজিকভাবে এখনও একটি ‘ মেয়েলি’ বিষয় হিসেবে দেখি। তাই সন্তান জন্মদান তথা লালন-পালনের সেই সনাতন ধারণা, ‘এটি শুধুই নারীর দায়িত্ব’ থেকে আমরা এখনও সমাজ তো মুক্ত নই, কখনও কখনও নারী নিজেও মুক্ত নয়। তাই সরকারিভাবে মাতৃত্বকালীন সুবিধা যাই থাকুক না কেন, তা বাস্তবে প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, যেখানে সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনকে ‘নারীর একক দায়িত্ব’ না ভেবে ‘সামাজিক দায়িত্ব’ হিসেবে আমরা দেখতে শিখবো।

যখন মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও ছুটি বিষয়টি কর্মক্ষেত্রের রাজনৈতিক আদর্শ ও প্রতিশ্রুতির সাথে সম্পৃক্ত হবে, তখনই এটি কেবল ‘নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন ইস্যু’ হিসেবে মানুষ মনে করবে। যতদিন আমাদের মনোজগতের এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটি না হচ্ছে, এটি কেবলই নিছক নারীর জন্য একটি কল্যাণমুখী বিষয় হয়ে থাকবে।

২. কেমন হওয়া চাই মাতৃত্বকালীন সুবিধাকে ঘিরে আমাদের মনোজগৎ?
আমাদের রাজনৈতিক একটা চেতনা জাগ্রত করতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে যে কর্মক্ষেত্র মাতৃত্বকালীন সময়ে নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা ঐ কর্ম-প্রতিষ্ঠানের একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়, তা নারীর যেমন প্রাপ্য অধিকার, আবার তা নারীর কর্মপ্রণোদনা ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিসহ প্রতিষ্ঠানেরও কর্ম উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

এবং এটি হতে হবে একটি উইন-উইন জায়গা থেকে, যেখানে সহানুভূতির পরিবর্তে সমানুভূতি প্রকাশই হবে আদর্শিক লক্ষ্য, এবং উভয় পক্ষের ( Employer and Employee) এক ধরনের জবাবদিহিতা থাকবে। জবাবদিহিতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এ ধরনের সুবিধার মূল উদ্দেশ্যই হলো নারীর মাতৃত্বকালীন অবস্থায় সে যেন উন্নত পরিবেশ পায়, যা তার বর্তমান ও ভবিষ্যত কর্মদক্ষতাকে সমুন্নত রাখবে। এজন্য employer এর যেমন প্রতিশ্রুতি হবে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধাপ্রদানের জন্য আধুনিক ও যুগোপযুগী নীতিমালা প্রণয়ন ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখা। ঠিক employee’র দায়িত্ব হবে তার মাতৃত্বকালীন সময়ের সঠিক পরিকল্পনা করা এবং অফিস  এর  ম্যানেজমেন্টের সাথে এক ধরনের negotiation বা bargaining এ আসা, যে কোন ধরনের কাজ বা দায়িত্ব পালন করলে তার শারীরিক কোন রিস্ক থাকলে তা প্রতিহত করা সম্ভব, যা তার কর্মদক্ষতা কমাবেনা, কিন্তু তাকে পূর্ণদমে active রেখেই তার কাজ ও ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। এখানে একটি বিষয় সবার কাছে পরিস্কার থাকা প্রয়োজন যে, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধাপ্রদানের মানে নারীর দায়িত্ব লঘু করা নয়, বরং তার পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে মানানসই ব্যবস্থা করা।

৩. আমার অভিজ্ঞতা:
এখানে আমার নিজের অভিজ্ঞতা না বললেই নয়। তখন ২০০৫ সাল, আমি অক্সফামের জেন্ডার প্রোগ্রামে কাজ করছি। দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক ‘WE CAN’  বা ‘আমরাই পারি’ ক্যাম্পইন বাংলাদেশে তখন তার পরিধি বিস্তার করছে। বাংলাদেশে ‘পারিবারিক নারী নির্যাতন’ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এটিই প্রথম ক্যাম্পেইন। ৩০টি জেলায় তখন ক্যাম্পেইন এর কাজ চলছে, ১২০টি বেসরকারি সংগঠনের দ্বারা গঠিত জাতীয় পর্যায়ের WE CAN এ্যালায়েন্স মাত্র যাত্রা শুরু করেছে, অক্সফাম তখনও সচিবালয়ের দায়িত্বে। জেন্ডার প্রোগ্রামে তখন আমরা মাত্র তিনজন, এম বি আখতার ভাই, তাহমিনা রহমান আপা ও আমি। মৃগাঙ্ক দা তার কিছুদিন পরে যোগ দেন। আমাকে সচিবালয়ের সকল কাজসহ ক্যাম্পেইনের কমিউনিকেশন মেটেরিয়ালস্, পার্টনারের বাজেট, নেটওয়ার্কিং দেখতে হতো। আমি conceive করার বিষয়টি যখন নিশ্চিত হলাম, অফিসকে জানালাম এবং টিম মিটিং এ সহকর্মীদের সাথে শেয়ার করলাম। আমার কী কী শারীরিক সীমাবদ্ধতা আছে তাও শেয়ার করলাম। যেহেতু সংগঠনটি অক্সফাম যা কিনা জেন্ডার সংবেদনশীলতার জন্য সারা বিশ্বেই সমাদৃত এবং যার জেন্ডার পলিসি একটি উদাহরণ হিসেবেই উল্লেখিত, তাই আমার জন্য বিষয়টি সহজ ছিল। কিন্তু যে কারণে অভিজ্ঞতাটি শেয়ার করছি, তা হলো employee হিসেবে কিভাবে responsive হওয়া যায় মাতৃত্বকালীন ছুটি  ও সুবিধা ভোগের  ক্ষেত্রে।

আমার এখনও মনে আছে সেই দিনটির কথা, যেখানে টিম মিটিং এ আমি আমার শারীরিক অবস্থার কথা ও চাহিদাগুলো এবং কোন দায়িত্ব আমি স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে করতে পারবো তা বলছি। মনে করছি কিভাবে আমার জন্য একটি flexible ও alternative plan তৈরি হলো সকল টিম মেম্বারদের সহযোগিতায়। যে সিদ্ধান্তটা সবাই মিলে সেদিন নিয়েছিলাম, তা ছিলো:

ক. টিমের সবার দায়িত্ব reallocate হলো। আমার ঢাকার বাইরের সকল ট্রাভেল এর দায়িত্ব অন্য দুজন শেয়ার করলো।
খ. ডেস্কভিত্তিক কাজগুলো আমি বেশী নিলাম।
গ.  প্রথম একমাস বাসা থেকেই কাজ করলাম। জীবনে প্রথমবার ২৬ পর্বের টিভি সিরিয়াল ( পারিবারিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ক্যাম্পেইনের জন্য) এর জন্য মেসেজ কী হবে, বিষয় কী হবে তা নিয়ে কাজ করলাম জনপ্রিয় নাট্যকার ও পরিচালক এর সাথে। সিরিয়ালটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল এশিয়াটিক। আমার জন্য দারুণ এক সময় ছিল গর্ভধারণের প্রথম সেই দিনগুলি, যখন আমার সন্তানের শরীর যেমন একটু একটু করে আমার মধ্যে পূর্ণতা পাচ্ছিল, ঠিক তেমনি ক্যাম্পেইনটি বাংলাদেশে একটি বিশালতার দিকে এগোচ্ছিল। এবং আমার সন্তান সম্ভবা পরিস্থিতি কখনই আমাকে ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করেনি। বরং আমাকে নিয়মিতভাবে যুক্ত রেখেছে।
ঘ. পরবর্তী মাসগুলিতে আমি flexible office hour ব্যবহার করেছি। কম সময় কাজ করিনি, বরং কর্ম ঘন্টা ঠিক রেখে সময়টা আমার সুবিধা অনুযায়ীই ব্যবহার করেছি।
ঙ. যে দিনগুলিতে বাসায় অফিস করতাম, কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজে আমার স্বাক্ষর দরকার হতো, মতামত দরকার হতো, তখন সহকর্মীরা আমার বাসায় চলে আসতো জরুরি মিটিং করার জন্য।
চ. পরবর্তীতে জমজ কন্যা হবার কারণে আট মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছিলাম (উল্লেখ্য যে তখনও সরকারিভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬মাস হয়নি। ) যা একটি দীর্ঘ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে অর্জিত, সে গল্প আরেকদিন বলা যাবে।

৪. মাতৃত্বকালীন সুবিধা : আমাদের অধিকার সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ
এত লম্বা ফিরিস্তি দেয়ার কারণ, আজকে টিউলিপ সিদ্দিকের বক্তব্য দেখে আবারও মনে হলো, সবসময়ই পরিবর্তনের জন্য কাউকে না কাউকে আওয়াজ তুলতে হয়, উদাহরণ তৈরি করতে হয়।

আমার অভিজ্ঞতাটি কিন্তু অক্সফামের বাংলাদেশ প্রোগ্রামের জন্য একটি উদাহরণ ছিল, কিভাবে জেন্ডার পলিসি ও মাতৃত্বকালীন ছুটিকে প্রয়োগ করা যেতে পারে, ম্যানেজারসহ টিম কি ভূমিকা রাখতে পারে। পক্ষান্তরে আমারও লক্ষ্য ছিল এই বিষয়টি সরাসরি, খোলাখুলিভাবে ম্যানেজমেন্টের কাছে পেশ করা, যার মধ্য দিয়ে সবার সচেতনতা ও বিষয়টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়।

একটি বিষয় নারী হিসেবে সকল নারীর জন্য বলতে চাই, তাহলে নিজের সচেতনতা এবং আত্মবিশ্বাস ও সাহসের সাথে নিজের অধিকার অর্জনের জন্য নিজের সচেতন দায়িত্ববোধটি পালন করা।  মাতৃত্ত্বকালীন সময় নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগার কোন কারনই নেই, এটি কোন নারীর জন্য দূর্বল অবস্থা নয়। ঠিক তেমনি এই বিশেষ সময়ে নিজের কর্মদক্ষতা কমে যাবে, এই ভেবে কর্মক্ষেত্রের ক্ষমতায়ন কাঠামো বা  প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে না রেখে কিভাবে এই বিশেষ সময়ের চ্যালেন্জটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়, নিজের ক্ষমতায়নটাকে সচল রাখতে হয়, সেই আলোচনাটাই বর্তমানের জন্য জরুরী। ঠিক যেমন চ্যালেঞ্জটি করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের পার্লামেন্টের প্রতি।

আশা করছি টিউলিপ সিদ্দিকের আওয়াজটি যেন শুধুমাত্র ব্রিটেনের পার্লামেন্টেই  নয়, আমরা  যারা ‘ নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন’ শব্দটির ব্যবহার করছি, বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি, সকলের ঘুম ভাঙায়। আর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের ও সমাজের প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতার জায়গাটি মজবুত করে।

লেখক: উন্নয়ন কর্মী

শেয়ার করুন: