ভয় আর লজ্জা এই নারীর সত্ত্বা

Pregnant 3রওশন আরা বেগম: টরন্টোতে ডাফরিন মল নামে একটা শপিং সেন্টার আছে। প্রায় সেখানে আমাদের যাওয়া হয়। আমি প্রথম যখন কানাডায় আসি তখন বাসার কাছেই এই শপিং সেন্টারটি ছিল। সময় অসময় সেখানে প্রায় কাটাতাম। দেশের জন্য তখন মন খুব খারাপ থাকতো। আর এই এই শপিং সেন্টার ছিল মনকে ভাল করার একটা উপায়।

তখন আমি ছিলাম একা এক নারী। মনের নানা বিষন্নতাকে কাঁধে নিয়ে এই মলে ঘুরে ঘুরে মনকে ভাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতাম। এই শহরে শাখা ছাড়া আমার কেউ ছিল না পরিচিত।

নাইমা সিদ্দিক নামে আমার এক বাংগালী ফ্যামেলী ডাক্তার ছিলেন কাছেই। সেখানেও প্রায় যাওয়া হতো। একদিন সে যখন আমাকে জানালো ‘তুমি প্রেগন্যান্ট’, তখন আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। ভয়ে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

তখন সে আবার আমকে বললো, তুমি কি খুশী না? তখনও আমি এর কোনই উত্তর দিতে পারি নাই। দেশ থেকে যে সংস্কার বয়ে এসেছিলাম সেটি ছিল এই মনে। ভয় আর লজ্জা এই দুটোর মিশ্রণে গড়া আমাদের এই বাংগালী নারীর স্বত্ত্বা। তখনো আমি বুঝতে পারি নাই সীমানা পেরিয়ে আমি এক নতুন মূল্যবোধ সংযুক্ত সমাজে এসে দাঁড়িয়েছি। এখানে ভয়ের কোন কারণ নেই, তেমনি লজ্জা পাবারও কোন কারণ নেই। এখানে নতুনের আগমনকে স্বাগত জাননো হয় অত্যন্ত আনন্দের সাথে।

Pregnant 2আর লজ্জা, কিসের লজ্জা? যে যৌনতার মাধ্যমে এক নতুন মানুষের জন্ম দিতে যাচ্ছি সেতো অনেক আনন্দের একটি বিষয়। আর ভয়, কিসের ভয়? নতুন অতিথির ভরণ পোষণ দিতে ব্যর্থ হবো এই ভয়? না এখানে সেই ভয়ও নেই। আমি দিতে ব্যর্থ হলে তার ভরণ পোষণ এই সরকারই নেবে।

সেইদিন আমি ছিলাম লজ্জা আর ভয়ে কাতুরে এক নারী। আমি জানি বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী বাচ্চা পেটে আসাকে আজও অত্যন্ত লজ্জা ও ভয়ের একটা বিষয় মনে করে। এর পিছনে ধর্মের একটা প্রভাব রয়েছে। যে যৌনতার মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হচ্ছে সেই যৌনতাকেই অচ্ছুৎ ও আড়াল করে যৌন অপরাধের মাত্রাকে অনেক গুন বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এখানে নতুন বাচ্চার আসার আনন্দ নিয়ে মেয়েরা উঁচু পেটটি গর্বের সাথে বের করে দিয়ে দিব্যি সব কাজ করে যাচ্ছে।

আমরা বাচ্চা পেটে আসা মাকে অসুস্থ মা বলে আখ্যায়িত করি। বাচ্চা পেটে আসা নারী কিভাবে অসুস্থ নারীতে পরিণত হলো?

এখনো শুনতে পাই, ভাইদের মুখে ‘তোমার ভাবী অসুস্থ’। কী অসুখ জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর পাওয়া যায় না। বাচ্চা হবার খবরটির মধ্যে তাদের কাছে আজও খুব একটা অসম্মান আর লজ্জা জড়িয়ে রয়েছে। তাই এই খবরটাকে অত্যন্ত গোপন রেখে অসুস্থ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

Pregnant 1বাচ্চা পেটে আসা নারীর অবস্থাকে যে সমাজ আজও স্বাভাবিক অবস্থানেই আনতে পারেনি সেখানে নারীর অধিকার কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে? শুধু এখানেই শেষ নয়। উঁচু পেট যাতে কেউ না দেখতে পারে এজন্য ভালভাবে ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়।

এই সময় গর্ভবতী নারীকে লোকজনের সামনে যেতেও মানা করা হয় পরিবার থেকে। ১০টা মাস কী লজ্জা আর ভয়ের ভিতরেই না সেই নারীকে কাটাতে হয়। কিন্তু এটা কার লজ্জা? কে দিয়েছে নারীকে এই লজ্জা? আমাদের সমাজ, আমাদের ধর্ম, আমাদের পুরুষেরা নারীর উপর জোর করে এই মিথ্যা লজ্জা বসিয়ে দিয়েছে।

যে নারী পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হয়, সেই ধর্ষক পুরুষটি দিব্যি সমাজে চলতে-ফিরতে পারলেও, নারীটি আর কোনদিনও কোথায়ও জায়গা পায় না। এটা কি নারীর অপরাধ? তাকে চিরদিনের জন্য অন্ধকূপে ফেলে দেওয়া হয়। সমাজ, সংসার, মা বাবা, ভাইবোন কেউ আর সেই ধর্ষিত নারীর দিকে ফিরেও তাকায় না।

নারী হয়ে জন্ম হওয়াই যেন তার অপরাধ। এই অবস্থায় সেই নারীর আশ্রয় ঘটে কোন এক নিষিদ্ধ পল্লীতে যার থেকে সে আর কোনদিনও বের হয়ে আসতে পারে না। নারীর প্রতি এইভাবেই চলছে সমাজের নানা অবিচার। এদিকে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে একটার পর একটা অপরাধ করার সুযোগ পেয়ে যায়।

সমাজে একটা কথা আছে ‘নষ্ট নারী’। কে এই নারীকে অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে? নষ্ট নারী হয়নি, নষ্ট হয়েছে এই সমাজ। তাই নষ্ট সমাজের কিছু নমুনা আজ এমনভাবে ফুটে উঠেছে যা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার কোনই প্রয়োজন নেই। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীর প্রতি চরম অবমাননামূলক ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই কারণেই নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমেই নারীর নির্বাচনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় চুড়ি, কানের দুল, আলতা, নেলপালিশ ইত্যাদি।

এটা আমাদের নারীর জন্য কত বড় অপমান জনক ঘটনা!! এরা কারা যারা বার বার নারীকে অপদস্থ, অপমান করে যাচ্ছে? নারীদের পক্ষ থেকেই এই ধরনের অপমানজনক নির্বাচন বন্ধ করা উচিত।

এটি একবার নয়, বার বার একই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তাই নারীর মাথার উপর অনেক বড় একটা বোঝা এসে হাজির হয়েছে। এই বোঝা নারীর সৃষ্টি নয়, তাহলে কেন সেই বোঝা এই নারীকেই বহন করতে হবে? যে নারী দশ মাস দশ দিন নিজেই বহন করে যায় একটা পুরুষের কামের অংশিদারিত্ব, সেই নারীতো সবার গর্বিত নারী হওয়া উচিত ছিল। তা কেন হয়নি?

এই নারীই হলো নতুন প্রাণের সঞ্চারক। এই কানাডায় এসে দেখতে পেলাম গর্ভধারণ নারীর একটা বড় গর্ব। তাই তো এখানকার নারী পেট উঁচু করে গর্বের সাথে জানান দিয়ে যায়, আমি এই পৃথিবীর উপর নতুনের বার্তা বাহক এক গর্বিত নারী। আশা করি বাংলার নারীরা ঠিক এইভাবেই একদিন জেগে উঠবে।

শেয়ার করুন:

আপনার লেখা বরাবরই কেন যেন আমার কাছে এক নতুন বার্তা বয়ে আনে। এবার ও তাই । আমরাও একদিন জাগবো এই প্রত্যাশায় ঘুমাতে যাই প্রতিদিন ————————- অনেক শুভ কামনা আপনার জন্য।