সুমন্দভাষিণী: বিশ্বজুড়ে যখন হ্যাপি ব্লিডিং বলে হল্লা-চিল্লা চলছে, ঠিক তখনই আমার এই ব্লিডিং বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সেই কবে তের বছরের সন্ধিক্ষণে শুরু হয়েছিল এই ‘যন্ত্রণা’, সাতচল্লিশের শেষেও এসে তীব্র তার উপস্থিতি। একেবারে সেই নবোউদ্ভিন্নো যৌবনা যেন। যেমনি তার ব্যথা, তেমনি তার প্রবল ধারা। প্রতি মাসে সে এসে স্নাত করে দিয়ে যায় আমাকে, আমি আবার নতুন করে জেগে উঠি বাঁচার আনন্দে, ঠিক ফুরিয়ে যাওয়ার আগে আবারও স্ফূরণের মতোন।
তবে আপাতত এই অনিয়মটা ঠিক মেনোপজ কিনা, বুঝতে পারছি না। পাঁচ মাস আগেই তো নিয়মিত পিরিয়ড চলছিল, কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল, সেইসাথে শুরু হলো থেকে থেকে হট ফ্লাশ। এসির নিচেও ঘামতে শুরু করলাম আমি। সবাই যখন শীতে কাতর, আমি তখন স্ট্যান্ড ফ্যান চালিয়ে রাখি মাথার পাশে।
সবগুলো লক্ষণই মিলে যায় মেনোপজের সাথে। মনে মনে প্রস্তুতি নেই নতুন সময়ের। যার সাথে কথা হয়েছিল জীবনের এই সময়টাতে সে আমার পাশে থাকবে, যেহেতু সে আর থাকেনি, কাজেই সামনের পথটুকু একাই পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নেই মানসিকভাবে।
বন্ধুদের কেউ দুষ্টুমি করে বলে, ‘তুমি শেষ হয়ে গেলে’? আবার কেউ বলে, ‘আবার নতুন উদ্যমে শুরু হলো জীবন, এনজয়’। আমার যে জীবন, তাতে শুরুই কী, আর শেষই কী! উদ্যমই কী, এনজয়ই বা কী! যাকগে, এই অবস্থায় সাড়ে পাঁচ মাস পাড়ি দেয়ার পর একদিন আবার শুরু হলো ‘ক্ষরণ’। পিরিয়ডকে ‘ক্ষরণ’ বলছি এ কারণেই যে, দীর্ঘদিন পর শুরু হওয়ায় এমন বাঁধভাঙা তার উচ্ছাস যে, একে রীতিমতোন দস্যুতা না বলে পারছি না। আর টাকা তিন সপ্তাহ ধরে প্রবলবেগে চলমান এই ধারাকে তাই ‘ক্ষরণই’ বলতে বাধ্য হলাম।
আবারও এক বন্ধুর মন্তব্য, ‘তার মানে তুমি শেষ হয়ে যাওনি’। তার মতে, এজন্যই নাকি আমাকে আগের চাইতে অনেক ‘ফ্রেশ’ দেখাচ্ছে। বাসায় ফিরে আয়নায় মুখ দেখি। ফ্রেশ কোথায়? এতো রক্তশূন্যতা রীতিমতো! ঠোঁট সাদাটে হয়ে গেছে, মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর ঘুরাচ্ছে, চোখ ঘোলা হয়ে আসে থেকে থেকে।
এক ডাক্তার বন্ধু সব শুনে ধমক লাগায়, ‘এখনও যাওনি কেন ডাক্তারের কাছে?’ ওর পরামর্শ মতোন সিরিয়াল দেই নামকরা একজন গাইনীর ডাক্তারের কাছে। জানি না, ঊনি কী বলবেন, কারণ তিন সপ্তাহ ধরে এই প্রবহমান ধারা বন্ধের কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। যদি ঊনি ভয়াবহ কিছু বলেন? তার চেয়ে ‘আমার সব শেষ’ হয়ে যাওয়াই কী ভাল ছিল না?
সেই আশি সালের ২রা এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছিল, দিনটি এখনও স্পষ্ট মনে আছে। এসএসসি পরীক্ষা চলছিল। আমি তখন ক্লাস এইটে, আমাদের বাসায় তিনজন পরীক্ষার্থী সেবার। প্রায় প্রতি বছর বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন পরীক্ষা দিতে আসতো আমাদের বাসায় থেকে। সেইবার তিনজন ছিল। বাসাভর্তি লোকজন। এর মাঝে আমার ‘ঊনি’ এলেন। এর কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমার ধারণা ছিল, কোনো মেয়ে কারও সাথে শুলেই কেবল এটা হয়, ‘ভাল’ মেয়েদের হয় না। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় একটা মেয়ের হলো, যার নামে বদনাম ছিল ছোট্ট মফস্বল শহরে, কাজেই ‘খারাপ’ মেয়েদেরই যে ব্লিডিং হয়, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিতই ছিলাম। তখনও এ সম্পর্কে কেউ কোনো ধারণাই আমাকে দেয়নি।
কিন্তু ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার এক নিকট আত্মীয় পড়তে এলো আমাদের বাসায় থেকে। দুদিন পর যখন তারও হলো, তখন আমার বোধোদয় হলো। আর সেই মেয়েও আমাকে বোঝালো যে, এটা সবারই হয়। বয়সে মাত্র দেড় বছরের বড় সেই মেয়ে ছাত্রী হিসেবে খারাপ হলেও, সেদিন সে আমাকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় সম্পর্কে এমনভাবে বুঝিয়েছিল যে, আমি মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম সেদিনটির জন্য।
কাজেই যখন আমার পায়জামা ভিজে গেছিল, আমি তারই শরণাপন্ন হই। সে আমাকে সুন্দর করে দেখিয়ে দেয় কী করতে হবে। তখনকার দিনে প্যাড ছিল না, থাকলেও তা আমাদের নাগালের মধ্যে ছিল না। সে আমাকে কাপড় ব্যবহার দেখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এর আগে প্রতি মাসে তার পিরিয়ডের সময়টাতে তাকে যেরকম ফ্যাকাশে দেখতাম, তাতে আমার পিলে চমকে যেতো। বাসায় কেউ জানতো না আমরা এ দুটি প্রাণী ছাড়া। এসময় যে আলাদা করে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয় আছে, খাওয়া-দাওয়ার বিষয় আছে, কে করবে আমাদের জন্য? তাই আমরা ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আর পা জড়াজাড়ি করে হেঁটেই পার করে দিয়েছি একটা বিশাল সময়। বাসাভর্তি লোকজনের মধ্যে এতোটুকু আড়ালের অবকাশ ছিল না, সেইসব ন্যাপকিন ধুয়ে রোদ দেয়ার কোনো উপায় ছিল না, লুকিয়ে রাখতে হতো, কতোদিন ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি বসলেই রক্ত লেগে যাবে ভয়ে। এখন মনে হলে শরীরে কাঁটা দেয়, মা-বোন-ভাবী, কাউকে আপন মনে হয়নি, কারও সাথে শেয়ার করতে পারিনি। এতো অপরিচ্ছন্ন একটা সময় গেছে আমাদের। সেদিক দিয়ে এখনকার মেয়েরা অনেক ‘লাকি’। তবে জানা হয় না, গ্রামে-গঞ্জে এখনও মেয়েরা নিজেদের এভাবেই আড়াল করে কীনা! এভাবেই স্বাস্থ্যের অপচয় ঘটায় কীনা অপরিচ্ছন্ন থেকে!
তবে সেই আত্মীয় মেয়েটি আমাকে এটাও বলেছিল যে, এখন যদি আমার কারও সাথে ‘শোয়া’ হয়, তাহলে আমি মা হয়ে যাবো। কিন্তু সে এটা খোলাসা না করায় এমন এক আতংক ভর করেছিল তখন আমার যে, স্বপ্ন দেখতেও ভয় পেতাম। মনে হতো, স্বপ্নে যদি আমি কারও সাথে থেকে ফেলি এবং এর ফলে প্রেগন্যান্ট হয়ে যাই, তাহলে তো বাসায় জায়গা হবে না আমার। কী অস্বাভাবিক জীবনযাপন, ভাবুন তো! এখন মনে পড়লে হাসিও পায়, আবার ক্ষোভও হয় মায়ের প্রতি, বোনের প্রতি। কেন তারা আমাদের সঠিকভাবে ধারণা দেয়নি? তবে এখনকার মেয়েরা অনেক স্মার্ট, কিছু ক্ষেত্রে একটু বেশিই স্মার্ট। সব জানে ওরা। কতো ফ্রি-ভাবে তারা সব কথা বলে!
আমি আমার মেয়ের নয় বছর বয়সেই জানিয়েছিলাম একথা। কাজেই তার একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিলোই। তাছাড়া প্রতিটি সময়ই তার এই বিষয়টি তার চেয়ে আমিই বেশি নজরে রেখেছি, নিজে কিনে দিয়েছি প্যাড। কোথাও গেলে কিভাবে তা ব্যবহার করতে হবে, সেটাও মনে করিয়ে দিতাম আমিই। কখনও কখনও ছেলেকে এই বিষয়টার সাথে সম্পৃক্ত করতেই তাকে দিয়েও এই কেনার কাজটি করিয়েছি। ছেলে যেন হঠাৎ এ নিয়ে আকাশ থেকে না পড়ে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা।
কিন্তু মেয়ে আমার বেজায় খুশি আমার মেনোপজের খবরে, তার ভাবনা, যাক, প্রতিমাসে আর যন্ত্রণা সইতে হবে না আমাকে। সে তো জানে না, আমি রীতিমতোন উপভোগ করেছি আমার এই ‘নারীত্ব’। পেটে ব্যথা, চোখ-মুখ পা্ংশুটে হয়ে যাওয়া বা কোথাও যাবার ব্যাপারে নিজের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ বা বাড়তি সতর্কতা নেয়া, এসবের পরও মাসের এই কয়টা দিন আমার ভিতরে একটা ভালো লাগা কাজ করে। তাই বয়স বা শরীর দুটোর প্রতিই আমার একটাই আবেদন, মেনোপজকে এতো তাড়াতাড়ি ঘেঁষতে দিও না আমার কাছে।
আরও ঝরুক আমার শরীর থেকে, আমি আরও কিছু বছর প্রাণবন্ত থাকি, উচ্ছল থাকি যৌবনা হয়ে।