সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সচেতনতা

Kalo haatহাসিনা আক্তার নিগার: বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। বাস্তবে সন্ত্রাসবাদের নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশ সারাবিশ্বের জন্য নজীরবিহীন হুমকি।

সন্ত্রাস যেমন শান্তিপুর্ণ রাজনীতির জন্য হুমকি ঠিক তেমনিভাবে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তায়ও হুমকি। মোট কথা বিশ্ব মানবতাবোধ এখন সন্ত্রাবাদের কাছে জিম্মি। বিশ্ব নিরাপত্তাকে যে সস্ত্রাস জিম্মি করে রেখেছে সে সন্ত্রাস বিষয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে।

নানা বাধা-বিপত্তির মাঝেও সারা বিশ্বের সকল দেশই সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজনিজ দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থাৎ প্রত্যেক দেশেই তার নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়াদি পর্যালোচনা করেই সন্ত্রাস দমনের কার্য পরিচালনা করে। আবার সকল দেশের সন্ত্রাসের ধরনও এক নয়। তাই সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ সেখানে বেশ কিছু বাধা আছে।

Draupodi 1যে বিষয়গুলি প্রাথমিকভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন তাহলো, সন্ত্রাসের মূল সংজ্ঞা কী? সন্ত্রাসী কে? কোন ধরনের কার্যকলাপকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে চিহ্নিত করা যাবে? কেউ আবার সন্ত্রাসীদের সংজ্ঞা নিয়ে বিপাকে পড়ে – কে সন্ত্রাসী? সন্ত্রাসীদের কাজ কী বলা যেতে পারে? এ বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্বের সকল সম্প্রদায় দ্বিধাবিভক্ত। এরপর যে বিষয়টি সমস্যা তা হলো সন্ত্রাস মানব জীবনে কতটা হুমকিস্বরূপ তা অনুধাবন করা।

ধর্মের বিধিবিধানকে সন্ত্রাসবাদের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও বিষয়টি খুব বেশী যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ পৃথিবীর কোন ধর্মই সন্ত্রাসকে সমর্থন করে না। আর যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাস করে প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের নিজেদের ধর্মকে কলুষিত করে। বস্তুত সন্ত্রাসের বা সন্ত্রাসীর কোন ধর্ম নেই, সন্ত্রাস হলো একটি জঘণ্যতম ঘৃণ্য অপরাধ। সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব একদিকে যেমন সন্ত্রাসের উৎস হিসাবে কাজ করে ঠিক তেমনিভাবে সন্ত্রাস দমনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ রাজনৈতিক উপযোগিতা, স্বতন্ত্র এবং আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে অকার্যকর করা হয়েছে।

সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ‘ক্রুসেড’ বলায় বৈশ্বিক জোট হতে প্রায় এক বিলিয়নের চেয়ে বেশি মুসলিমরা বাদ পড়ে গেছে। যার ফলে একটি স্বতন্ত্র এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ ঘটেছে। ‘সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী জোটে ইসলামিক ফেসিজম’ শব্দটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। রাজনীতির সংকীর্ণতার কারণে রাজনৈতিক দলগুলো অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, জাতীয়তাবাদী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিরোধ আন্দোলন এবং বহিরাগত সন্ত্রাসী সকলকে যেনতেনভাবে বিভিন্ন কাতারে ভাগ করেছে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সহযোগিতা হ্রাস পায় এবং সকল প্রচেষ্টা বিবর্ণ হয়ে যায়।

আবার দেখা যায়, যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে, তারাই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্ব জোটকে দুর্বল করে। বস্তুত সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনকারীদের আরও বেশী উদ্দেশ্যপূর্ণ এবং বস্তুনিষ্ট হতে হবে। তাহলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমে আরও বেশি নিবেদিত, দৃঢ়সংকল্প এবং বিচারক্ষমতা সম্পন্ন হবে।

Free 1জাতীয় পর্যায়ে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে খুব খারাপভাবেই রাজনৈতিক এবং রাজনীতিবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। বহিরাগত বঞ্চিত কিছু মুসলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবঞ্চনার স্বীকার হন। এতে করে তাদের মধ্যে সন্ত্রাস এবং সহিংসতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার প্রচেষ্টা দেখা যায়। জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের মানুষ সন্ত্রাস এবং সহিংসতা বিরোধী। যাই হোক, সংকীর্ণমনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য কিছু রাজনৈতিক নেতারা সন্ত্রাসকে মদদ দিয়ে থাকে এবং তাকে নীরব পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক হিসাবে কাজ করে থাকে। এ কারণে দেশে জাতীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জাতীয় যুদ্ধে স্থূল রাজনৈতিক কলঙ্কের কারণে আইন প্রক্রিয়া সংস্থা এবং আইনের শাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা দুর্বল হয়ে পড়ে। জাতীয়, আঞ্চলিক, এবং বৈশ্বিক বিভিন্ন কারণের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কার্যক্রম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক অপরাধী, চোরাচালানকারী, দুর্নীতিবাজ অফিসার, দেশদ্রোহী রাজনীতিবিদ এবং সীমান্ত সন্ত্রাসীদের সাথে যোগসূত্রকারীরা সীমান্তের উভয় পাশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবে সন্ত্রাস দমনের জন্য সরকারী পর্যায়ে কার্যক্রমের গতিশীলতার অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।

সার্ক সম্মেলনে আঞ্চলিকভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ পরিচালনার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মাঝে বাস্তবিক সগযোগিতা আদান-প্রদান হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সন্ত্রাসী চক্রের কোনরূপ সর্ম্পকের প্রমাণ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করতে কিছু জাতীয় এবং আঞ্চলিক সংগঠনের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও, জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক গোয়েন্দা সংস্থা এর কোন সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক সকল শ্রেণীর সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করার জন্য বাংলাদেশ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান আর্ন্তজাতিক সংস্থার সাথে জোড়ালোভাবে কাজ করছে।

প্রকৃতপক্ষে, রাজনৈতিক জোট, অসহযোগ এবং অবিশ্বাসের কুয়াশাচ্ছন্ন রাজ্য পরিচালনা করতে, জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের রাজনীতি সন্ত্রাসীদেরকে উৎসাহিত করে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতীয় কার্যক্রমের বিচ্ছিন্নতা বন্ধ করতে হলে সকল দায়িত্বশীল এবং প্রধান ধারার রাজনৈতিকদের সচেষ্টা হওয়া প্রয়োজন। আর তখনই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূমিকা দেশে বিদেশে আরও ভালভাবে উপস্থাপিত হবে এবং উপলদ্ধি করা যাবে।

সন্ত্রাস বিরোধী জাতীয় কার্যক্রমে আমাদের দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রদান করতে পারেনি। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যথাযথভাবে উচ্চতর খাতে প্রবাহিত করার জন্য সবার সহযোগিতা, আন্তরিকতা ও সমর্থন থাকা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গঠিত আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনকে সন্ত্রাসের ভীতি দূর করতে আমাদের জাতীয় প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সংসদীয় রাজনীতির জাতীয় ধারায় বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তিকে এক হতে হবে।

এ বিষয়ে আমরা যত বেশি সক্ষম হব, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের সমষ্ঠিগত যুদ্ধ আমাদেরকে তত বেশি শক্তিশালী, সংহতি এবং ঐক্যবদ্ধ করবে। সুশাসন এবং দুর্নীতির অবনতি হলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ অনেক ফলপ্রসূ হবে। দুর্নীতিবাজ অফিসার এবং রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার প্রবণতা বাড়ায়, এমনকি তারা তখন সন্ত্রাস দেখে না দেখার ভান করে। সরকার এবং সংসদীয় বিরোধী উভয় দলই দুর্নীতির হ্রাস এবং ভাল সরকারের দায়িত্বশীলতা বহন করে। জাতীয় সংসদকে সন্ত্রাস দমনের জন্য জাতীয় সংলাপ, সযোগিতা এবং প্রচেষ্টার জন্য মূল্যবান কর্মপন্থা তৈরী করা উচিত।

আশা করা যায়, আমাদের নেতাদের রাজনৈতিক জ্ঞান দুর্নীতির হ্রাস এবং সুশাসনের জন্য জাতীয় ঐক্য গঠন করতে সাহায্য করবে যাতে আমাদের জাতি উন্নত দৃঢ়সংকল্প ও স্থিতিস্থাপকতার সাথে সন্ত্রাস হুমকির মোকাবেলা করতে পারে। সন্ত্রাসের প্রকৃতির কারণেই যারা সন্ত্রাস দমনের কাজ করবেন তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। সংকীর্ণ জাতীয় বিষয়সূচি এবং শুধুমাত্র সামরিক ক্ষমতার দ্বারা এই বৈশ্বিক যুদ্ধ নিরূপণ করা অদুরদর্শী এবং নিষ্ফল হবে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সামরিক এবং সমাজ-সংস্কৃতি অভিযানসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ বিন্যাসে এই জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। এছাড়া বৈশ্বিক সম্প্রদায় এই বৈশ্বিক যুদ্ধের জাতীয় পর্যায়ে অংশ যুদ্ধ করতে পারে। এই যুদ্ধ বিজয়যোগ্য।

শেয়ার করুন: