আমাকে আপনি পশু করে দিন!!

Kannaশারমিন শামস্: আজ আর কিছুই লেখার নাই। শুধু আকাশের দিকে দুই হাত তুলে বলতে পারি, হে ঈশ্বর, আমাকে বলে দাও মানুষ কাকে বলে? মানুষের সংজ্ঞা কী? আমি আর এই পরিচয়ে স্বস্তি বোধ করি না। আমি লজ্জিত, আমি ভয়াবহ লজ্জিত। আপনি আমাকে তুলে নিন।

অথবা আমাকে পশু করে দিন। একটা ছাগল, ভেড়া, বাঘ, হাতি, সিংহ, কুকুর, বিড়াল, হায়না, নেকড়ে, কুমির কিংবা পাখি বা প্রজাপতি… যা আপনার ইচ্ছে হয়, করুন। তবু এই মনুষ্য জন্মের লজ্জা থেকে আমাকে বাঁচান।

এই চৌদ্দ কোটির দেশে ঈদের শপিং চলছে ধুমসে। আমি শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকা সাত আট বছরের বাচ্চাটাকে টপকে গাড়িতে উঠি। আমার হাতের ব্যাগে নিজের সন্তানের জন্য একাধিক জামা।

আমি কারো কাছে কখনো জানতে চাইনি, কেন যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ধরে তারা একই রকম ফুটপাতে পড়ে থাকে। আজ ফেসবুকে যারা রাজন নামের তেরো বছরের শিশুটাকে মেরে ফেলার দৃশ্য আপলোড করেছে, আমি সেই ভিডিও দেখে শিউরে উঠেছি, কিন্তু কারো কাছে জানতে চাইনি, কেন এরকম? কেন? কেন? কেন এই দুঃসাহস? কীভাবে এই দুঃসাহস? আমার বিবমিষা হয়েছে সারাদিন। আমি কোথায় লুকাই?
যাকাত নামের প্রহসনের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই রাজন এসে আমার গা্লে চড় মেরে গেছে। লাথি কষিয়ে গেছে। আমি নিজের ওপর ঘেন্নায় নিজেকেই চিনতে পারছি না আর।

আমার তেরো বছরের ভাগনি এবার ঈদে গাউন কিনেছে। দামি, ঝলমলে। আমি ওর দিকেও আর তাকাতে চাইনা। আমার লজ্জা করছে।

আমি ভালো আছি, আমরা ভালো আছি, আমাকে বা আমার সন্তানকে এখনো কেউ খুঁটিতে বেঁধে পেটায়নি। আমাদের সবজি বেচতে হয়না। আমরা ফুটপাতে ঘুমাই না। আমরা যাকাতের কাপড় নামে তৃতীয় শ্রেণী মানের কাপড়ের জন্য ভোররাতে গিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়াইনা। আমার তাই ইচ্ছে করছে মাটিতে মিশে যাই। আমার ইচ্ছে করছে আমি মরে যাই। কিংবা একটা গরু বা ছাগল হয়ে জন্ম নিই্। ঘাস খাই। হাম্বা ডাকি।
আমি ‘এদেশের’ মানুষ বলেই সকাল হলেই এইসব আস্ফালনও ফুরাবে।

আমি ঈদের সেমাই রাঁধবো। টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান দেখে দেখে গরু খাসী মুরগি পায়েশ চড়াবো। লোকজন ডেকে আনবো। খাও খাও। ঈদ বলে কথা। শপিং যা করেছি, সব প্রদর্শনের সুযোগ চাই। শাড়ির জন্য খরচ করেছি অন্তত পনেরো থেকে বিশ হাজার। আর বুয়ার শাড়িটার দাম আড়াইশো থেকে তিনশ। বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করে, ওর জামার দাম পাঁচশ। অনেক খরচ করে ফেলেছি।

বাড়িতে দুই দুইটা খাট খালি পড়ে থাকে। তবু মেয়েটা মাটিতেই মাদুর বিছিয়ে ঘুমায়। তার খাটে বা সোফায় বসা নিষেধ। মেয়েটা রান্নাঘরে খায়। এটাই এ ব-দ্বীপের প্রাগৈতিহাসিক নিয়ম। এই নিয়ম কেউ ভাঙ্গবে না। ভাঙ্গলে বলা হবে, ঢং। তাই নিয়মেই গা ভাসাই আমরা। ঈদ করি। ঈদের নামাজ পড়ি। রোজা রেখেছি মাস জুড়ে। যাকাত দিয়েছি। ফেতরা দিলাম। উফ কী ধার্মিক আমরা। ঈশ্বর, তুমি খুশি তো? দেখো হিজাব পরছি। রঙ মাখছি একটু, ঢঙ করছি বিস্তর, তাতে কী? সারাবছর রাস্তায় থু থু করে থুতু ফেলছি। আর জুম্মাবারে সেই রাস্তাতেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছি। তুমি খুশি তো?
এইসব ঘটবে। আমি আবার ফিরে যাবো নিজের জীবনে। কোথায় রাজন, কোথায় ২৭ জন যাকাতের কাপড় নিতে আসা মানুষের মত দেখতে মানুষ?

আমার মনে নেই। শুধু আজ এই রাতটুকু ভুলতে পারছি না। ছোট্ট বাচ্চাটাকে ভুলতে পারছি না। কেন বিচার হয় না, এই অক্ষম ভাবনা থেকে উদ্ভুত ক্রোধ দমন করতে পারছি না। মনে হচ্ছে সব ভেঙ্গেচুড়ে ধ্বংস করে ফেলি। মনে হচ্ছে টুটি চেপে ধরি। মনে হচ্ছে আমি এইবার মরে যাই।
আজ নিজের প্রতি, স্বজাতির প্রতি তুমুল ঘেন্না নিতে না পেরে আমি অসুস্থ বোধ করছি। আমাকে, হে ঈশ্বর, তুমি পশু করে দাও।   কোন পশুকে কখনো দেখিনি নিচে নামতে। কোন পশুকে দেখিনি এরকম মানুষ হয়ে উঠতে।

আমি মানুষের হাতে মানুষ আর মানুষের হাতে পশুকে নির্লজ্জভাবে মরতে দেখেছি, ধর্ষিত হতে দেখেছি, ধর্ষণের পর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত করতে দেখেছি। আমি দেখেছি ছোট্ট বিড়াল ছানার গায়ে গরম মাড় ঢেলে দেয় ভদ্রবেশি ভদ্রমহিলা। রাস্তায় পথ চলতে কুকুরের গায়ে ঢিল ছোঁড়ে কত লোক। পাশে দাঁড়িয়ে কারা হিহি করে হাসে? মানুষই তো? এই বাংলাদেশের মানুষ।

ঈশ্বর, ঈশ্বর, আমি আর দেখতে চাই না। আমাকে তুলে নাও। আমাকে তুলে নিয়ে ছেড়ে দাও গহীন অরণ্যে। যেখানে মানুষ নাই। মানুষের ছায়া নাই। আমার মস্তিস্ক থেকে সব স্মৃতি ধুয়ে মুছে দাও। বাংলাদেশ নামের একটা জঘণ্য নোংরা পচা গলা দেশে আমি জন্মেছিলাম, এ কথা যেন আর ভুলেও মনে না পড়ে আমার। এই রাত পোহাবার আগেই ঘটিয়ে দাও এমন কিছু। তা না হলে, রাত ফুরালেই আমি ভুলে যাবো সব। ভুলে যাবো রাজনকে। তোরে বছরের ছোট্ট বাচ্চাটা! আমার বাচ্চাটা! ছোট্ট সোনাটা! আমাকে তুমি তুলে নাও হে ঈশ্বর! আমি পাপী, আমাকে তুমি ধ্বংস করে দাও!

শেয়ার করুন: