পেশাদারিত্ব যখন আমাদের মার খায়

3_Sylhet-Child-Murder-9সুপ্রীতি ধর: ভীষণভাবে মার খেয়ে গেল পেশাদারিত্ব আজ। সাংবাদিক হিসেবে কিছুতেই নির্লিপ্ত থাকতে পারলাম না, মেরুদণ্ড সোজা রেখে চেয়ারে বসে কাজ করতে পারছি না। নিউজ পড়তে গিয়ে বার বার গলা বুঁজে আসছিল, চোখের সামনে অক্ষরগুলো যেন চলে যাচ্ছিল, জলচোখে ভুল খবর পড়ে এসেছি আমি। আমারই কেবল এই অবস্থা, তা নয়।

আমার যে সহকর্মী আজ নিউজটি করলেন, তিনিও পাগলের মতোন একই কথা বলছিলেন ভিডিওটি দেখা এবং শোনার পর। তার ভিতরের অস্থিরতা গ্রাস করেছে সবাইকেই। নিউজ করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন তিনিও।

আরেকজন সহকর্মী সেই বিকেল থেকে পড়ে আছেন একই খবর নিয়ে। কাজ তার কিছুই এগোচ্ছে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের এতো ভাল খেলার আওয়াজ ভেসে আসছে নিচের এবং উপরের তলাগুলো থেকে, দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেট পতনের সাথে সেকী উল্লাস সবার, কিন্তু আমাদের মন বেদনায় ভারাক্রান্ত।

আজ আর ক্রিকেট দেখা হবে না আমাদের। বাংলাদেশ জিতলেও আজ কিছুই যাবে-আসবে না আমার বা আমাদের অনেকেরই।

খবরটা এরকম: সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চোর ‘অপবাদে’ এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি হত্যাকারীরা। তারা সেই হত্যার দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার পর তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে নির্যাতনের সেই দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করেন নির্যাতনকারীদেরই একজন, যা ওই ভিডিওর কথোপকথনে স্পষ্ট।

নিহত সামিউল আলম রাজন(১৩) সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের মাইক্রোবাস চালক শেখ আজিজুর রহমানের ছেলে। গত ৮ জুলাই সকালে শিশুটিকে হত্যার পর লাশ গুম করার চেষ্টার সময় পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। স্থানীয় অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা রাজন সবজি বিক্রি করত।

ভিডিওটা দেখার সাহস আমি করতে পারিনি। এর আগে নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে একটি ছেলেকে পিটিয়ে মারার দৃশ্য দেখেছিলাম সময় টেলিভিশনের কল্যাণে। কয়েকদিন লেগেছিল আত্মস্থ হতে। তারপর ভয়ংকর খবর হয়ে আমাদের সামনে এসেছিল সাভারের আমিনবাজারের কাছে ডাকাত সন্দেহে ছয় কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। আমারই ছেলের বয়সী এক ছেলে ছিল সেই নিহতদের মধ্যে, যে কিনা ইংরেজি মাধ্যমে পড়তো।

সেই ঘটনার পর অভিভাবক মহলে একধরনের আতংক নেমে এসেছিল নিজ নিজ সন্তান নিয়ে। আমার ছেলেকে নিয়েও আমি অস্থির দিন কাটাতাম সেইসময়টা। সয়ে যায় সবকিছু। আর পোড়ার এই দেশে কোনো ঘটনারই বিচার হয় না। শাহবাগ আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জে নৃশংসভাবে খুন করা হয় ত্বকী নামের এক কিশোরকে, যার আয়ত চোখ এখনও আমাকে ঘুমের মধ্যে তাড়িয়ে ফেরে। আমি অস্থির বোধ করি। ঈশ্বরের অস্তিত্বে খুব একটা বিশ্বাস আমার নেই, তারপরও মনে হয় একটু বিশ্বাস করে তাঁকে বলি, ‘আমাকে অন্ধ-বধির করে দাও, আমি যে আর পারছি না নিতে’।

আজ সেইরকমই ভিডিওটির খবর শুনেই আমি/আমরা অসুস্থ বোধ করছি। ছেলেটির আর্তচিৎকার কানে ভাসছে, পাশাপাশি ওই জল্লাদদের অট্টহাসি, পানি খেতে চাওয়া ছেলেটির, কী নৃশংস, কী অমানবিক আমাদের চারপাশ।

ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর ফেসবুকে সবাই নড়েচড়ে বসেছে। প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। কেউই সহ্য করতে পারছে না এই ঘটনাটি। বন্ধু সাংবাদিক জায়েদুল হাসান পিন্টু লিখেছেন, ‘যে পশুগুলো সিলেটের ওই শিশুটিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তাদের একটাও যদি পার পেয়ে যায় তাহলে খবর আছে। সিলেট পুলিশের বড়ো এক কর্তাকে বললাম তোমারও কিন্তু ১৩ বছরের…..’। আমি জানি এটা ওর রাগের কথা, ক্ষোভের কথা, যেখানে হার মেনেছে তার পেশাদারিত্বও।

উম্মে রায়হানা মুমু লিখেছেন, ‘এর আগে সামিউল নামের একটি শিশুকে মেরে ফ্রিজের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছিলো। এই ঘটনায় তার মা আর মায়ের প্রেমিককে গ্রেফতারও করা হয়েছিলো। 
মনে আছে, নিজের ছেলেকে পাশে নিয়ে দুই তিন রাত জেগে কাটিয়েছিলাম… 
ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছিলো কি? প্রকৃত খুনি চিহ্নিত হয়েছিলো? বিচার বা শাস্তি … কিছুই কি হয়েছে? মনে হয় না … 
এই সামিউল হত্যার বিচারও হবে না … চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় … 
নিষ্ঠুরতা নির্মমতার কথা আমি ভাবছি না… শুধু ভাবছি কতখানি দুঃসাহস থাকলে এই রকম পৈশাচিক কাজ করে সেই ভিডিও প্রচার করা যায়? এত সাহস কোথায় পায়? 
পায় কারণ ওরা জানে বিচার হবে না… শাস্তি হবে না…’

নাদেরা সুলতানা নদী লিখেছেন, বাংলাদেশের সিলেটের এই ঘটনায় ‘’মানসিক ভাবে অসুস্থ’’ বোধ করছি। একটা বাচ্চা ছেলেকে এমন করে মেরে ফেললো, ওখানে কি একজনও মানুষ ছিলোনা? এটা কিভাবে সম্ভব, আহা একটা ছোট বাচ্চা, কত কষ্টই না হয়েছে সোনা জাদু’’টার। বাবা তুই এই সব দানবীয় ‘’মানুষ দের ক্ষমা করিসনা কিন্তু, কোনদিন ও না’’!!! বোবা কষ্টে, দুখে, রাগে চিৎকার করে কান্না আসছে, ঘাতকের কি বিচার হবে??? (কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহু দূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুর-অসুর)!!!

ফারহানা রহমান লিখেছেন, কি হচ্ছে এসব? কেন এধনের বীভৎসতা, বর্বরতা আমাদের দেখতে হচ্ছে? কিছুতেই ভিডিওটা দেখতে পারলাম না। দেখা সম্ভবও না। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষগুলো কেন এমন ভয়ানক বর্বর আর নিশংস হয়ে উঠলো সেটা ভাবতে হবে সবাইকে। এর মানে কি? সবাই কি তাহলে বিশ্বাস করা শুরু করেছে যে আইনের শাসন বলে কিছুই নেই। যার যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। একটা ছোট্ট শিশুকে এভাবে অত্যাচার করে মেরে ফেললো আর সেটা ভিডিও করে প্রচারও করে দিলো। কি ভয়াবহ সাহস? কিন্তু এতো সাহস কি করে পায় ওরা?

বিবিসি বাংলার ফেসবুক পেজে একজন লিখেছেন যেন অভিযুক্তদের ফাঁসি দিয়ে সেটা ভিডিও করে আমাদের দেখানো হয়। সত্যিই আমাদের সবার চাওয়াটা আজ এরকমই। একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা চাই। আমরা তো আর ‘মানুষ’ বলে, নিজেদের কোনরকম সভ্য বলেও পরিচয় দিতে পারছি না।

শেয়ার করুন: