সেলাই দিদিমনিরা নিরাপত্তা চান ক্রেতা দেশগুলোর কাছে

rana plaza
ফটো কার্টেসি: New Age

উইমেন চ্যাপ্টার (২১ জুন): ২৪শে এপ্রিল থেকে ২১ জুন, মাঝে দুটি মাস চলে গেছে। এখনও সাভারের রানা প্লাজার সামনে মানুষের ভিড়, কিছু কৌতূহলি, কিছু স্বজনহারা। কেউ আবার ছবি তুলে নিচ্ছে। অসংখ্য ব্যানারের ছড়াছড়ি। কোথাও লেখা ‘আমরা শোকাহত’, কোথাও বা বেতন আট হাজার টাকা করার দাবি। মাঝে একটি দাবি চোখে পড়ে, হতাহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এখানে একটি সৌধ নির্মাণের দাবি। ঢাকায় বসে রানা প্লাজাকে মানুষ ভুলে গেলেও এখানকার মানুষের মনে এখনও স্মৃতির অতলে হারায়নি।

আহতরা এখনও ভিড় করছেন সাহায্য-সহযোগিতার আশায়। কারও বুকে-পিঠে ব্যান্ডেজ, কারও বা পা অনুভূতিহীন। তারপরও তারা ছুটছেন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের লোকজনের কাছে। এখনও আসছেন বিদেশিরা। নেদারল্যান্ডের একজন নারীকে দেখলাম বাংলায় কথা বলছেন আহতদের সাথে। অস্ট্রেলিয় সাংবাদিক বেন ডোহার্টির সাথে আমার সাভার যাওয়া। বেন বার বার করে একটা প্রশ্নই জানতে চায়, এই আহত শ্রমিকরা কবে নাগাদ কাজে ফিরতে পারবে? তারা কি আদৌ ফিরবে? ভবিষ্যত নিয়ে তাদের কী ভাবনা?

রানা প্লাজার পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশই বেনের এই প্রশ্নের উত্তর জানে না। তারা ম্লান হাসে। বলে, ‘যখন ভাল হয়ে যাবোম তখন সাভারকে ‘সালাম’ জানিয়ে গ্রামে ফিরে যাবো’। আমি বেনকে বলি, এই সালাম মানে ‘গুড বাই’, এর মানে পোশাক কারখানার কাজকে বিদায় জানানো। বেন বুঝতে চেষ্টা করে, কেন ওরা গরীব হওয়া সত্ত্বেও এই কাজকে ‘সালাম’ জানাবে।

এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর অধিকাংশেরই হাত নেই, পা নেই, কারও বা দুটো পা-ই নেই। শরীরের কোন একটি অংশ এখন হাওয়ায় দুলছে, দেখতেই গা শিউরে উঠে। দুপুর বেলায় বেশ গল্প-গুজবে মেতে আছে অনেকেই। ঘা শুকিয়ে আসছে শরীরের। কিন্তু মনের ঘা শুকাতে কতদিন লাগবে, তা জানা নেই। সেই চেষ্টাও করিনি। অবাক হয়ে দেখি তাদের মনের জোর। কারও দুটি মেয়ে আছে, সেই মেয়েদের পড়াশোনা করার স্বপ্ন চোখে-মুখে। একটি মেয়ে, বেশ মায়াবী মুখ তার, শুনলাম, কোনদিন সে আর মা হতে পারবে না। তার পেটের ওপর ভারী কিছু পড়ায় জরায়ু কেটে ফেলতে হয়েছে। সেখানেই শুনলাম আইসিইউতে আছে একটি ছেলে, যার জ্ঞান এখনও ফেরেনি। কিছু মেয়েকে দেখে বয়সটা নিয়ে সন্দেহ জাগে মনে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে ওরা বয়স লুকিয়ে কাজে ঢুকেছে, বেশ বোঝা যায়। এই বয়সেই এতো ভার, জীবন সইবে তো?

মাথার ওপর রোদের প্রচণ্ড উত্তাপ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফিরলাম শ্রমিকদের। এক বাসায় গিয়ে শুনি, মেয়েটি টাকা পেয়েছে বিকাশে, তাই আনতে গেছে। সেই বাড়িতেই কথা হয় পা অসাড় হয়ে যাওয়া এক কিশোরীর সাথে। সারাক্ষণ পায়ে বিশেষ ধরনের ব্যান্ডেজ আর জুতা পরে থাকতে হয়। তার মায়ের সান্ত্বনা, ‘পা খোড়া হউক, মেয়েরে তো জানে ফিইরা পাইছি! বেন মাটিতে শুয়ে-বসে বেশ কিছু ছবি তুললো তার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার জন্য। সাদা চামড়া দেখে মানুষ ভাবে, এই বুঝি সাহায্য এলো! বেন খুব ভালোভাবেই পড়তে পারে ক্ষতিগ্রস্তদের চোখ-মনের সেই ভাষা। আমাকে বলে, ‘আমার কি উচিত কিছু টাকা দেয়া’? টাল সামলাতে না পারার অভিজ্ঞতা থেকে তাকে বিরত রাখি এ যাত্রায়।

এনাম মেডিকেলে আরও একটি গল্প শুনে আসি। কিছু মেয়ের স্বামী টাকার লোভে ফেরত এসেছিল, টাকা নিয়ে চলেও গেছে। এমনও আছে, যে কিনা চলে গিয়ে ফোন করে বলেছে, ‘তিন লাখ নিয়ে গেলাম, যৌতুকের আরও দুই লাখ হলে সংসারে ফিরিস’। তাদের ধরতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে একটি স্বেচ্ছাসেবী দল।

মানুষের দারিদ্র্য, শতচ্ছিন্নতা ভাবায় না দিল্লিতে থাকা বেন ডোহার্টিকে। তাকে ভাবায়, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার কি বিচার চায় শ্রমিকরা। শ্রমিকরাও তাকে জানিয়ে দেয়, ‘রানা আর পোশাক কারখানার মালিক, সবাইরে ফাঁসি দিতে অইবো’।

জানলাম, বেনের বাংলাদেশের আগমনের মূল উদ্দেশ্য, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের পোশাকের বাজারকে কিভাবে আরও সম্প্রসারিত করা যায়, তা। তাজরীন পোশাক কারখানাটিও দেখতে যাই আমরা। সেখানেই বাঁশঝাড়ের নিচে জড়ো হন অনেক শ্রমিক। তারা বেনের কাছে অনুরোধ জানায় যেন রিপোর্টটি এমনভাবে তিনি করেন, যাতে ক্রেতা দেশগুলোই তাদের মজুরি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। তাদের ধারণা, এইদেশের মালিকরা কখনই তাদের দিকটা ভাববে না। বেন তা নোট করে নেন।

ফিরে আসার পথে কথা হয় সামান্যই। একটা কথাই বলি, বাজার সম্প্রসারণের কাজ করতে এসে নতুন কিছু অ্যাঙ্গেল নিয়ে যাচ্ছো তো? তোমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের বলো, আমাদের গরিব খেটে-খাওয়া মানুষগুলো একটু নিরাপত্তা চাইছে তাদের কাছে। আর এটা নিশ্চিত করা গেলে ওরা অনেক পণ্য দেবে তোমাদের। বেনও বলেন, এই দেশের জনসংখ্যাটা আসলে সমস্যা না, সমস্যা হলো ওদের সঠিকভাবে ব্যবহার না করা আর রাজনীতিতে দুর্নীতি। রাজনীতি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া- এ দুটোও আমাদের পরবর্তী ‘অভিযান’। লিখবো সময়মতো।

লেখক: সুপ্রীতি ধর

শেয়ার করুন: