আয়শা আক্তার কণা: মাইগ্রেশন নিয়ে একটা লেকচার শুনছিলাম, সেখানে শুরুতে যেভাবে মাইগ্রেশন শুরু হয়েছিল তা বলতে যেয়ে বলছিলেন ফোর্স মাইগ্রেশন এর কথা, মানে আসামীকে যেভাবে দ্বীপে নিয়ে ফোর্সলি ডাম্প করা হতো সে সময়ের কথা। তারপর এলো ইন্ডস্ট্রিয়াল নিড বেজড মাইগ্রেশন এবং অবশেষে এখনের নিজ ইচ্ছার ইকনমিক্যাল মাইগ্রেশন এর কথা।
এ নিয়ে বলতে বলতে একজায়গায় বক্তা বলে বসলেন, “যেকোনো মাইগ্রেশনেই পুরুষরাই ছিল টার্গেট। তাই তাদের মাঝেই ধীরে ধীরে এটা ডেভেলপ করে যায়, বা পুরুষরাই সহজে এডোপ করতে পারে অনেক কিছুই, কিংবা তাদের জীবনেই আছে অনেক অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা”।
মন দিয়ে শুনতে শুনতে হঠাৎই আমি ধাক্কা খেলাম এই পয়েন্টে এসে কেন যেন। তাৎক্ষণিকভাবেই আমার মনে হচ্ছিল কোথাও ভুল হচ্ছে আমাদের। মনে হচ্ছিল পুরুষ থেকে একজন নারী আরো বেশী কষ্ট বা এডাপটেশনের অভিজ্ঞতায় ডুবে আছে, এবং নিয়মিতভাবেই…
দেশকে একক না ধরে যদি ঘর বা পরিবারকে একক ধরি তাহলেই জিনিসটা আরো পরিষ্কার হবে আশা করি। মানে ধরি আমি যদি নিজেকে একজন সাধারণ নারীর প্রতিনিধি হিসেবে দেখি তাহলে কি দেখি, আমার জীবনের মাইগ্রেশন তো প্রতিনিয়ত ও অবধারিত… এটা হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। যা নিয়ে ইতিহাস কখনোই ভাবেনি!
মাইগ্রেশন এ লিড রোল প্লে করে বড়রা, মানে প্রভাবশালী দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে কন্ট্রোল করে থাকে। বড় দেশ ছোট দেশকে যেমন করে তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তেমনি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজও চাপিয়ে দেয় শুধু নারীকেই মাইগ্রেট করতে এবং অবশ্যই অভিযোজিত হতে। প্রতিটা নারীকে একটা বয়স পরে বাধ্য করে নিজের চেনা ঘরকে ছেড়ে দিতে, পাড়ি দিতে সম্পূর্ণ অচেনা এক পরিবারে একদল মানুষের মাঝে যাদের চিনি না, জানিনা, আগে কখনো দেখিনি বা যাদের চিন্তা ও চেতনার সাথে হয়তো কোন মিলও নেই তারপরেও সেই ঘরে ঠাঁই হয় একটা প্রাপ্তবয়স্ক নারীর।
পূর্ণ বা প্রাপ্ত বয়সের মানুষকে যদি ভাঙ্গতে হয় বা অনেক বেশী অমিলের সাথে মিলতে হয় তার মত কঠিন যে আর কিছু নেই তা ব্যক্তি বিশেষের ভালোই জানা আছে সম্ভবত…
কি কঠিন যে এই এডাপটেশন প্রক্রিয়া, হায়…
ভয়ংকর চাহিদার সাথে চলতে চাওয়াই একজনের জন্য বড় বেশী হয়ে উঠলেও কেইবা শুনবে তার কথা। একেবারেই নতুন করে জন্মাতে হয় সেই বিয়ে করা মেয়েটিকে। ওই মা-বাবাকে মা-বাবা ভাবা, ওদের ভাই-বোনকে ভাই-বোন করে নেয়া, ওই অচেনা ঘরের গন্ধটিকে নিজের ঘরের মত করে করে ফেলা, ওদের রুচি আর কথার মত করে কইতে ও পড়তে শেখা। এমনকি খাবার-দাবারের ধরনও হয়ে থাকে তাদের মতই… নিজের প্রিয় গান বা আরাম বা পা ছড়িয়ে আড্ডা! কি জানি হয় কিনা কারো কপালে আবারো… সব ভুলে ওই স্থানটির মত করে করতে যেয়ে প্রতিনিয়ক চলে কম্প্রোমাইজের সংগ্রাম।
এমনকি, যেই সন্তানটি আসে তাকেও তাদের মত কালচার আর শিক্ষায় বড় করার প্রচেষ্টায় নিজেকে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে সব হারিয়ে হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ আরেক মানুষ… মাইগ্রেশনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ এর চেয়ে আর কি কিছু আছে?
এর চেয়ে বড় মাইগ্রেশনের বড় অভিজ্ঞতা কি আর কোথাও আছে…
আর কারো আছে !!
যেই মা বা বউটি ভুলেই যায় সে অতীতে কি পড়তো, কি ভাবতো বা কি খে্ত !
কবে সে কোন এক বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় কি রঙের শাড়ি পড়ে ভেসেছে, হেসেছে বা কেঁদেছে!
তার মন কষ্টে নীল হলে কিভাবে সে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদেছে…
বা ঋতু বদলের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত সে কতবার তার মুড’ও বদলিয়েছে ঐ ঋতুর সাথে পাল্লা দিয়ে…
আমিতো জানি আমি তা করিনি, আমরা আর তা করিনা আর…
বদলে গিয়েছি সেই থেকেই, বদলাতেই হবে অবধারিত জেনেই নিয়মে বদলেছি।
যে পারেনি সে মরেছে,
নিজের মুদ্রাদোষে দিনে দিনেই একা হয়েছে,
একা থেকে ক্রমশ আরো একা।
কেইবা চায় একা হতে।
ভাল বা মন্দ কোনটা সেটা আমার এখনের ফোকাস না, ফোকাস হলো, নারীর জীবনের মাইগ্রেশন এবং প্রতিটি নারীর জীবনের অবধারিত মাইগ্রেশন।
মাইগ্রেশনের কষ্ট একজন পুরুষের জন্য ঐচ্ছিক বা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়
কিন্তু নারীর জীবনে তা ঐচ্ছিক নয়…বাধ্যতামূলক।
মন খারাপ হয় ভীষণ…কবে হবে এমন জীবন যা সবার জন্যেই হবে সমান আনন্দের…