শিশ্ন ঈর্ষা নাকি গর্ভ ঈর্ষা!  

We can do itশামীমা মিতু: পুরুষের শরীরে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ দিয়েছে শাশ্বত শক্তি, দিয়েছে তাকে পৃথিবীর মালিকানা, ফ্রয়েড বাবুর মতে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্যতায় ভোগে, পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা করে পৌরুষের প্রতি।

নারীর নাকি শিশ্ন ঈর্ষা আছে! এই তত্ত্বের আফিমে বহুকাল ঝিমিয়েছে পৃথিবী। যুগে যুগে পুরুষ লেখকরাও কম আদিখ্যেতা করেননি এই অঙ্গটি নিয়ে। আসলে পুরুষ যে কর্তৃত্ব বিকারে ভোগে তার মূলে আছে পুরুষের হীনমন্যতা! অথচ কথাটার উল্টোটা শোনা যায়।

নারী-পুরুষ। যে যুগলবন্দীতে ইতিহাসের সঙ্গীত বেজে ওঠার কথা, পুরুষ তাকে বিকৃত করেছে, স্বরকে ভুল স্পিডে চালানো রেকর্ডের মতো করে তুলেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে পুরুষ কর্তৃত্ব সভ্যতার ইতিহাস প্রায় অসভ্যতারই নামান্তর। তবে তার চেয়ে বড় কথা তারা যে লিঙ্গবৈষম্য সৃষ্টি করেছে, তাতে মানব সভ্যতারই ক্ষতি হয়েছে।

মিলেট লরেন্স থেকে উদ্ধৃতি দেন-সে তার শার্ট খুলে ফেললো এবং তার(লেভি জেইন এর) দিকে স্থিরভাবে দাঁড়ালো। নিচু জানালা দিয়ে সূর্যরশ্মি ঢুকে তার উরু আর কৃশ উদরকে এবং জ্বলজ্বলে স্বর্ণলাল কেশের ছোট মেঘের ভেতর জেগে ওঠা কৃষ্ণাভ তপ্ত চেহারার দাঁড়ানো শিশ্নকে আলোকিত করে তুললো।  নারী ভাবলো, সে কি তার মতো……। এখন বুঝতে পারছি পুরুষ কেন এত কর্তৃত্বপরায়ণ। শেষে বলেছিল, শো, আমাকে হতে দাও। লরেন্স একজন পুরুষ, এইভাবে নারীকে পুরুষ শিশ্নের অধীন করেন। লরেন্সের নারী যে পুরুষের শিশ্ন দেখে বলে উঠেন, ‘আমাকে হতে দাও’- এটা পুরুষের কথা, নারীর মুখ দিয়ে বলিয়ে নেয়া পুরুষতন্ত্রের কথা।     

এমনই পুরুষতান্ত্রিক বিকার দেখলাম স্পোর্টস রিপোর্টার দেবব্রত বন্দোপাধ্যায়ের ‘এ শুধু জয় নয়, পৌরুষের ঘোষণা’ শিরোনামের একটি লেখাতে। যদিও এমন বিকারগ্রস্তের সংখ্যা এখনো আমাদের সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে এই ভদ্রলোকের উপস্থাপনটা একটু ভিন্নমাত্রার।

তার মতে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভারতকে হারিয়ে একটা বার্তা দিল। আর তা হলো- ‘আমরা পুরুষ মানুষ, আমরা বীরের মতো খেলতে পারি। আমরা ভীতুর মতো বাঁচি না, বীরের মতো প্রয়োজনে মরি। কয়েক বছর ধরে আমাদের ক্রিকেটের ব্র্যান্ডটাকে কিছুতেই পুরুষালি করতে পারছিলাম না।’

ক্রিকেটটাকে সবসময়ই একটা ‘কমন’ আবেগের জায়গায় দেখেছি। এইখানেই যেন কে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কে হিন্দু, মুসলিম, কে নাস্তিক, কে ছাগু সব মিলেমিশে একাকার! সেই আবেগে ভুল-ভাল মিশিয়ে শিশ্ন ঈর্ষার আফিম ঢোকালেন দেবব্রত।

এক টুকরো মাংসখণ্ডের এই দাপট পুরুষটি সৃষ্টি করেছে। কেন? আমি তো দেখি শিশ্ন ঈর্ষার পেছনে লুকিয়ে আছে পুরুষের গর্ভ ঈর্ষা!

পুরুষের অস্তিত্ব আসলে শূন্যে অবস্থিত। সে সৃষ্ট হয় নারীর গর্ভ থেকে, আবার তাকে সৃষ্টি করতে হয় নারীর গর্ভেই। মাঝখানে তার অবস্থান। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় তার ভূমিকা অপেক্ষাকৃত গৌণ। প্রথমত যে ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ সৃষ্টি হয়, সেই ক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা মুখ্য।

বর্তমানে সমকামিতাকে পুরুষতন্ত্রে যে প্রকাশ্যে গহন করা হচ্ছে, গে আন্দোলন বাড়ছে তার কারণই নারীর এই প্রাথমিক প্রাধান্যের হাত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। নারীবাদী ভাবনা যত বাড়ছে ততই পুরুষ পথ খুঁজছে অন্যত্র। তার থেকে বড় কথা নারীই মানুষ সৃষ্টির আধার, তার গর্ভেই মানুষ তৈরি হয়, পুরুষের এই সত্যটা মানা খুবই কঠিন।

পুরুষতন্ত্র ক্ষেত্র ও শস্য বীজের উপমা নিজে, নিজের প্রাধান্য বোঝাতে চায়, কিন্তু এ উপমা ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ছে।

কোথায় দরকার না পুননির্মাণ! সাহিত্যের পাতায় পাতায় চোখে পড়ে লিঙ্গবৈষম্য। ধর্মের বইতে এই বৈষম্যের আর আইনে তার প্রতিধ্বনি। সস্তার বিনোদন সিনেমা আর পরিবারের সঙ্গী টেলিভিশন এমনভাবে এই বৈষম্য উপস্থাপন করে যেন এটাই স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ!

Mitu
শামীমা মিতু, সাংবাদিক ও ব্লগার

ধর্ম বলে, নারী থেকেই পাপের জন্ম, পুরুষের ‘সহকারিণী’ মাত্র
আইন বলে, মা তার সন্তানের অভিভাবক নয়, ধাত্রী মাত্র। সন্তান পিতার
বিজ্ঞাপন বলে, নারী মা, নারী গৃহিণী, নারী এক অতি সুন্দর অলিক মানবী।
শিল্প বলে, নারী সুন্দরী, যৌন উত্তেজনা সঞ্চারিনী, প্রেরণাদাত্রী। শিল্প সৃষ্টি তার কাজ নয়।
সাহিত্য বলে, নারী প্রেরণা, নারী উর্বশী অর্থাৎ যৌনতার প্রতীক, নারী গৃহের লক্ষী। যে নারী সাহিত্য রচনা করে সে পুরুষের জগতে অনুপ্রবেশকারী ‘মহিলা কবি’ জাতীয়।
দর্শন বলে, মাতৃত্ব আর স্বামীসেবাই নারীর আসল দায়িত্ব, যা তাকে মহীয়সী করে।
সমাজ বলে, নারী মিসেস অমুক-পুরুষ, তার নিজস্ব কোনো পরিচিতি নেই।
অর্থনীতি বলে, সাবধান, এখানে নয়, কাজের জগৎটা পুরুষের, পুরুষ ভর্তা, নারীর ভরণপোষণের দায় তার। নারী নির্ভরশীল।
চাঁদের সাথে তুলনা করা হয় নারীকে, নারী কোমল। আর সূর্য হলো পুরুষ, তেজদীপ্ত। ভাষার সুক্ষ্ম কৌশলে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কে যন্ত্রী আর কে যন্ত্র।

তবে কিছু মেয়ে এই রেখা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তছনছ করে দিতে চাইছে স্ত্রী লিঙ্গ নির্মাণের ছক। ‘শিশ্নের প্রতি ঈর্ষা’ ধরনের নেশাগ্রস্ত বাণী দিয়ে তাদেরকে দমানো যাচ্ছে না। ফলে বহু পুরুষ, মগজ ধোলাই হওয়া নারী খেপে যাচ্ছেন। তাদের মতে সমাজ ছারখার হয়ে যাচ্ছে, পশ্চিমী উচ্ছৃঙ্খলা ঢুকে নষ্ট হচ্ছে আমাদের মহান ঐতিহ্য!

তা হোক না একটু ছারখার, পড়ুক না পুরুষতন্ত্রের কারখানায় ঢিল। আমরা যদি এর সুফল নাও পাই, আমাদের উত্তর নারীরা তো মানুষের এই পৃথিবীতে পূর্ণ মানুষ হয়ে বাঁচবে।  
 
সাংবাদিক ও ব্লগার

 

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.