ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী বনাম আত্মবিশ্বাস

Canada Tribal sতামান্না ইসলাম: যখন বুয়েটে পড়ি, আমার এক বান্ধবী একদিন বলল “তোর ভয় লাগে না?  হবু শাশুড়ি গাড়ি চালায়, এই শাশুড়ি ম্যানেজ করবি কিভাবে”?

সেটা ছিল নব্বই দশক, ঢাকায় হাতে গোনা কিছু মহিলা গাড়ি চালাতেন তখন। ওর কথা শুনে আমি খুবই অবাক।

আমি বললাম “গাড়ী চালায় তো কী, ঊনি তো আর বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার না।”  বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি যেয়ে দেখি আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। শাশুড়ি আম্মা আমার তুলনায় বেশ লম্বা, গলার স্বর অনেক জোরালো আর ব্যক্তিত্ব আমার চেয়ে তিনগুণ প্রখর। আমি বুয়েট পাস ইঞ্জিনিয়ার পুরা ভিজা বিড়াল হয়ে গেলাম।

আরও ক্যাচাল, শাশুড়ির ছেলের বিদেশীদের মত গায়ের রঙ, আমি শ্যামলা (মতান্তরে কালো)। হাজার হোক বাঙ্গালী মেয়ে, মনের ভিতরে খুত খুত। আজব ব্যাপার হলো বিয়ের আগের পাঁচ  বছরে এসব কিছুই মাথায় আসে নাই। কেউ কিছুই বলে নাই, বিশেষ করে আমার বরের তো এই ব্যাপারে একেবারেই মাথা ব্যথা নাই।

তার সাথে এই প্রসঙ্গে কথা উঠালে সে একদম পাত্তা দিত না। তার পরেও নিজের মনে মন কলা। একটা পরোক্ষ কারণ হয়তো ছিল, সেটা হলো এই পরিবারের যাবতীয় মহিলাকুল প্রচণ্ড ফ্যাশন সচেতন। আমি এই ব্যাপারে পুরাই নাদান।

ব্লাউজের গলা, জামার ফিটিং, থ্রেডিঙ, ফেসিয়াল কিছুই জানি না, বুঝিও না, হাই হিল পরে হাঁটতে গেলে আছাড়  খাই। নিজের খালা বিউটিশিয়ান, অথচ আমি বুয়েট লাইফ আলখাল্লা টাইপ জামা পরেই পার করে দিয়েছি। এদের বাড়িতে যেয়ে অথৈ সাগরে পড়লাম।

শাশুড়ি নিজ হাতে শাড়ি পরা শেখালো। তার পরেও সারাদিন মন ছোট হয়ে থাকতো, আমাকে ওদের সবার পাশে বড্ড  বেমানান লাগে। শ্বশুর বাড়ি যেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা হয়তো অনেক মেয়েই করে, একেকজন একেকভাবে। কেউ রান্না-বান্না করে, কেউ কথায়, আমি বোকার মত শুরু করলাম সাজগোজ করতে।

ময়দার মতো ফেস পাউদার মেখে সঙ সেজে নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত লাগতো, মনে হতো “ধুর আমাকে দিয়ে হবে না”। আমার শাশুড়ি খুব উচ্চ শিক্ষিত না হলেও বুদ্ধিমান, মানুষের মন বুঝেন এবং অনেক বাস্তব জ্ঞান রাখেন। ঊনি বোধ হয় আমার মনের অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।

আমাকে ধীরে ধীরে বোঝাতে শুরু করলেন, “মানুষের আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে তার আত্মবিশ্বাসে। তুমি নিজে যদি বিশ্বাস কর তুমি সুন্দর, তবেই অন্যের চোখে তোমাকে সুন্দর লাগবে। যতক্ষণ তুমি সেটা বিশ্বাস না করছো, ততক্ষণ যতই সাজো না কেন, যে জামা বা শাড়িই পরো, যে মেকআপই করো, তোমাকে সুন্দর লাগবে না। “

উনার কথা বুঝতে এবং বিশ্বাস করতে আমার বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে। উনি থেমে থাকেন নি। ধৈর্য ধরে একই কথা বার বার বুঝিয়েছেন। উনার সেই কথা আমাকে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। আজ আর আমার ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর দরকার নেই,  অপরূপা সুন্দরীদের পাশে দাঁড়াতেও আমার নেই কোন কুণ্ঠা, কারণ আমার আছে আত্মবিশ্বাস, সৌন্দর্যের আসল চাবিকাঠি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.