সোভিয়েত নারীর দেশে-২৯

ami 4
আমাদের সেই প্রিবাল্টিক সফরের একটি ছবি

সুপ্রীতি ধর: এবছর বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলাকালে বেশ কটি অঘটন ঘটিয়েছেন আমাদের স্বনামধন্য সাংবাদিক ভাইয়েরা। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির একজন বিমানে করে যাওয়ার সময় সহযাত্রীকে নিপীড়ন করায় এয়ারপোর্ট থেকেই সোজা শ্রীঘরে গিয়েছেন। আরেকজনের কথা শুনলাম এইমাত্র।

অস্ট্রেলিয়ায় যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বাংলাদেশের এশিয়ান টিভির সাংবাদিক মোঃ সোহেল রহমানের ২০ হাজার ডলার জরিমানা কিংবা প্রায় ছয় মাসের মতো জেল হয়েছে! এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে এইবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলার সময় তিনি যে হোটেলে থাকছিলেন, সেখানে এক কানাডীয় ছাত্রীকে ঘুমন্ত অবস্থায় শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলেন।

জানা গেছে, এই বাংলাদেশি সাংবাদিক যে হোটেলে থাকছিলেন সেটা ছিল “‘ব্যাকপেকার” টাইপ। কমদামি এই হোটেলগুলো মূলত পর্যটকদের পছন্দ। বহুতল শয্যার এসব হোটেলের কক্ষে একসঙ্গে পুরুষ-নারীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। স্বভাবতই নারীদের শুধুমাত্র সেক্স সিম্বল হিসেবে দেখা এই জাতির পক্ষে এমন ব্যবস্থায় নিজেকে ধরে রাখা দায়। তাদের ঝুলঝুল চরিত্র তাতে বিনা মেঘেই বজ্রপাত ঘটায় ক্ষণিকে ক্ষণিকে।

এসব শুনি আর ভাবি, একটা দেশের শিক্ষা মানুষকে কতটা নিচে নামালেই এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে উঠা সম্ভব। 

Soviet nari 2 Soviet nari 1 Soviet nari 3মনে পড়ে গেল আমার সোভিয়েত জীবনের কিছু স্মৃতি। অনেকদিন লেখাও হয়ে উঠছিল না সোভিয়েত নারীর দেশে, আজ একটু মুড ফিরে পেলাম এই খবরে। আমার এই কলামের যে শিরোনাম ‘সোভিয়েত নারীর দেশে’ তা অনেকাংশেই যথার্থ, অন্তত আমরা যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেখেছিলাম, স্পর্শ করেছিলাম, আস্বাদ-ঘ্রাণ পেয়েছিলাম, তাতে শতভাগ সত্যি এটা আসলেই নারীর দেশ।

একবার তৎকালীন লেনিনগ্রাদ থেকে লন্ডন গিয়েছিলাম পুরোটা পথ ট্রেনে করে। হক ভ্যান হল্যান্ডে গিয়ে জাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে হয়েছিল। রাতে দেখি অসংখ্য স্কুল-কলেজগামী কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী সব ছোটখাটো পোশাক পরে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সারাটা রাত সেবার নিজেদেরই ভুলে চেয়ারের টিকেট কাটায় ঘুম তো হয়ইনি, বরং হিংসায় কাতর হয়ে ওদের সেই ঘুম দেখছিলাম। একটি মানুষের মনেও কী কামের ইচ্ছা জাগেনি সেই তরুণীদের দেখে? আসার পথে আমরা নিজেরাও জার্মানির স্টেশনে ঘুমিয়েছিলাম বাংলাদেশি, নেপাল, শ্রীলংকান বন্ধুরা মিলে, একসাথে, পাশাপাশি। কী জানি বাপু, খুব বেশি আগের জমানার কথাও তো বলছি না, এরই মাঝে এতো পাল্টে যাওয়া সব!

সপ্তাহান্তে আমাদের বাঙালীদের আড্ডা ছিল অনিবার্য। যে কারও রুমেই হতে পারে। খাও-দাও, একসাথে হৈ চৈ, হাসিঠাট্টা, সিনেমা দেখা, তারপর যার যার মতোন ঘুমে ঢলে পড়া। হোস্টেলের রুম আর কত বড় হয়। আর সেই রুমে থাকতো দুটি বা তিনটি মাত্র সিঙ্গেল খাট। স্টুডেন্ট খাট। ভোরবেলায় যখন সূর্য উঁকি দিত, তখন আমাদের মনে পড়তো ঘুমানোর কথা। নিচে কার্পেটের ওপর চাদর বিছিয়ে মাথার নিচে যা-ইচ্ছে-তাই দিয়ে ছেলেরা ঘুমাতো, আর আমাদের মেয়েদের মাথা-পা উল্টা-পাল্টা করে ওই কংকালসার বিছানায় ঠাঁই মিলতো। আমাদের তাতেই আনন্দ ছিল। কেউ কখনও ভুলেও আমাদের শরীরে হাত দেয়নি।

খুব কঠিন করে বললে এভাবে বলা যায় কথাটা, ‘আমরা (বহুবচনেই বলছি) নিজে থেকে প্রেম করে কারও সাথে না থাকতে না চাইলে সেখানে কোনো বাঙালী ছেলের পক্ষেও সম্ভব ছিল না, আমাদের গায়ে হাত দেয়ার’। যে কারণে আমরা অনায়াসেই বন্ধুরা একে-অপরের হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে পারতাম, মনের কলুষতা না থাকলে, সেই স্পর্শে শরীরে আলোড়ন কমই জাগে, এটা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছি।  

সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক প্রজাতন্ত্রে ঘুরেছি, ওরা পাশ্চাত্যের দেশ হয়েও ততটা খোলামেলা ছিল না, কিছুটা রক্ষণশীলই ছিল। রুশ মেয়েরা তো ঘোর সংসারী, যা বাঙালী মেয়েদেরও পিছনে ফেলে দেয়। তবে ফর্সা চামড়া হলেই যে সেই মেয়ে সহজলভ্য হবে, এমনটি ভাবার কোন কারণ ছিল না। মেয়েটির সাথে যদি প্রেম হয়, মেয়েটি যদি সম্মতি দেয়, তবেই সে যেতে পারে কারও রুমে, নয়তো নয়। তবে যারা টাকার বিনিময়ে রুমে যেতো, তাদের কথা হাজার বছরের ইতিহাসের মতোই।

আমার সাড়ে নয় বছরের সোভিয়েত জীবনে কখনও নিজের শরীর নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগিনি, তা একলা রাস্তায় বা মধ্যরাতেই হোক, বা প্রচণ্ড ভিড়েই হোক। আমি তো একবার সেন্ট পিটার্সবুর্গের ২৬ জন বাঙালী তিন প্রিবাল্টিক রিপাবলিকে ঘুরতে যাচ্ছে শুনে পিছু নিলাম। স্টেশনে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যিই একজন মিসিং, আমাদের তরিকুল টিটো যাবে না। আমি সুপ্রীতি সেদিন তরিকুল হয়েই ট্রেনে উঠেছিলাম, আর ওর জায়গায় যাওয়ার কারণে আমার রুমমেট ছিল দুবছর না তিন বছরের ছোটভাই সাব্বির। কই, কোথাও তো অসুবিধা হয়নি! ভোররাতে সাব্বির আস্তে করে রুমের দরজা খুলে দেখে লাইট জ্বলছে, আমার হাতের গল্পের বইটা ফ্লোরে পড়ে আছে। ওটা তুলে রেখে আরও সন্তর্পণে সে গা এলিয়ে দেয় তার বিছানায়, এমনকি সে ওয়াশরুমে জলের শব্দটি পর্যন্ত করেনি আমার ঘুম ভেঙে যাবে বলে। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে এই গল্প বলে সে হো হো করে হেসেছে।

আমার কিন্তু সেদিন একটিবারের জন্যও মনে হয়নি, একটি ছেলের সাথে রুম শেয়ার করছি। ধরেই নিয়েছি, সাব্বির তো ছোট ভাই। আমরা ২৬ জন সেবার এতো মজা করে কাটিয়েছি কটা দিন যে ভোলার নয়। আমি একা মেয়ে ছিলাম সেই দলে, আমার জন্য কাউকে কোথাও বেগ পেতে হয়নি, দেরিও হয়নি।

তাই বলে সোভিয়েত জীবনে কি আমাদের প্রেম-ভালবাসা হয়নি? হয়েছে। কোনোটা টিকেছে, বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে, কোনোটা ভেঙে গেছে। সুখ-দু:খ নিয়েই আমরা পাড়ি দিয়েছি আমাদের প্রবাস জীবন। পড়ালেখা যেমন করেছি, তেমনি সেইদেশ থেকে সংস্কৃতিবোধ, ঔচিত্য-অনুচিতবোধ, পরিমিতিবোধ, সবই শিখেছি। কেউ কেউ এর ব্যতিক্রম ছিল বৈকি! কিন্তু সেটা আমার এই কলামের আলোচ্য নয়, ওই ব্যতিক্রমদের আমরা এড়িয়ে চলতাম, ওরা আমাদের আনন্দযজ্ঞ থেকে অনেক দূরের কেউ ছিল।

সোভিয়েতের পতনের পর সবচেয়ে বড় আঘাতটা এসেছিল এই বোধের ওপরই।

আমার সামনে একদিন ‘আদম ব্যবসায়ীদের’ হাত ধরে দেশটিতে যাওয়া একজন বাংলাদেশি ছেলে যখন একটি মেয়েকে দেখিয়ে বললো, ‘আপা, চকোলেট কিনে দিচ্ছি শুধুমাত্র ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য’, আমি মেয়েটিকে একনজর দেখে ছেলেটির মুখের দিকে তাকালাম। আমার সোভিয়েত বন্ধুরা কোনদিন আমাকে এটা বলার এই সাহসটুকু করতো কিনা জানি না, করেনি কখনও।

এই আদম হয়ে যাওয়া বাংলাদেশিদের কথা বললে আমার অনেক গল্প বলতে হবে। তাও হবে একসময়। সে এক বিরাট অধ্যায় সোভিয়েত পরবর্তী জীবনে, পুরো সিস্টেমকে ওলট-পালট করে দেয়া একটা সময় ছিল। দলে দলে দেশ থেকে প্রচুর টাকা খরচ করে রাশিয়া হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমাতো তারা। তখন রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখা মিলতো আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলা কিছু মানুষের, যারা বিদেশ কী জিনিস বোঝার আগেই ভাষা না জানা একটা দেশে এসে খাবি খেতো। প্রায়ই দেখা মিলতো বাঙালীদের হাতেই সর্বস্বান্ত হওয়া কিছু তরুণের। সে অনেক গল্প।

আমার আজ মনে হয়, যে সিস্টেম একটা মানুষকে ‘সত্যিকার মানুষ’ এর মানদণ্ডে ধরে রেখেছিল, সেই সিস্টেমের পতনের পর প্রথম আঘাতটা আসে সেই শিরদাড়ার ওপরই, আর সেটা করেছিল এই আমাদের মতোন বিদেশিরাই।  একদিকে একটা দেশের এই পরিণতি, আদম ব্যবসা, চোরাচালান, হঠাৎ কাঁচা টাকায় সয়লাব চারদিক, নৈতিক অধ:পতন মানুষকে পচনের মুখে ঠেলে দেয়, যেখানে থেকে আমরা যারা ‘সোভিয়েত পাবলিক’ ছিলাম, কেবলই হাঁসফাঁস করেছি মেলাতে না পেরে জীবনটাকে।

শেয়ার করুন: