মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বল রে…

girls 2
ছবিটি সংগৃহীত

উম্মে ফারহানা মৌ: আমার এক রুমমেট ছিলেন যারা পাঁচ বোন, তিনি নিজে চার নম্বর। তিনি দাবি করতেন যে তার মা-বাবার কোন আক্ষেপ নেই তাদের ভাই নেই বলে। শুনেছি তার মা চাকরি করতেন একসময়। কোন চাকরিতেই দুইবারের বেশি মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয় না।

চাকরিজীবী নারীর জন্য সন্তানধারণ ও সন্তানপালন দুটোই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং,গৃহিনী নারীর জন্য সহজ তা বলছি না। কিন্তু চাকরি করলে সন্তানপালনের জন্য যে ধৈর্য লাগে তাতে মাঝে মধ্যে ঘাটতি হতেই পারে। যা হোক, পুত্রের আশায় না হলে একজন গৃহিনী নারীর জন্যেও পঞ্চমবার সন্তানধারণ আজকাল কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। হয়ত আমার রুমমেটের মা-বাবা যথেষ্ট সংবেদনশীল ছিলেন বলে তাদের পুত্রহীনতার আক্ষেপ কন্যাদের সামনে প্রকাশ করেননি। কিংবা ধরেই নিচ্ছি যে তাদের কোন আক্ষেপ ছিল না। এতে কি প্রমাণ হয় যে বাংলাদেশের মা-বাবারা মেয়ে আর ছেলে সন্তানকে একই দৃষ্টিতে দেখেন?

আরেক মেয়ে, তিন বোনের ছোট বোন, জোর গলায় দাবি করছিল, তাদের বাসায় কোন জেন্ডার ডেসক্রিমিনেশন নেই। তার যেহেতু ভাই নেই সে তাই কোনদিন দেখেনি যে পড়া থেকে উঠে গিয়ে খেলা শেষ করে ফিরে আসা ভাইকে চা-টা বানিয়ে দিতে হয় বোনকেই। কিংবা ভাই একটা আস্ত ফজলি আম পেল তো দুই বোন পেল এক আমের দুই পাশের দুটি টুকরা, মা হয়ত আটিটা খেয়ে নিলেন। সে দেখেনি ভাই বিশ টাকা সালামি পেলে বোন পায় দশ টাকা, বোনের বয়স বার আর ভাইয়ের বয়স তিন হলেও।

আমরা যারা নানা রকম লিংগ বৈষম্যের শিকার হয়ে বড় হয়েছি, আমরা যারা ভাইকে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজাতে দেখেছি, নিজে প্লেয়ার ছুঁয়ে দেখতে পারিনি, ভাইকে সাইকেল চালাতে দেখেছি, নিজে ভাইয়ের সাইকেলের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে পারিনি (পাছে সাইকেলটা ব্যথা পায়), আমরা যারা কাঠবেড়ালির মতন পেয়ারা গাছ বাইতে পারতাম কিন্তু দাদীর চোখ রাঙানির ভয়ে গাছের তলা দিয়ে যেতে পারিনি, ভাই না পাড়লে পেয়ারা ঠুকরে খেয়েছে বুলবুলি, সেই তারাই তো বলবো বৈষম্যের কথা, অন্যায় আর অবিচারের কথা। আমার রুমমেটের মতন, বা তিনবোনের এক বোন সেই মেয়েটির মতন যারা বৈষম্য দ্যাখেনি তারাতো এই নিয়ে কিছু বলবে না স্বাভাবিকভাবেই।

সেদিন ফেইসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাস আপডেটে একটা মতামত দেখে একটু কষ্ট পেয়ে গেলাম। তিনি বলছেন, অনেকেই ফেইসবুকে নারীবাদ নিয়ে গলা ফাটায় আর নিজের বেডরুমে জামাইয়ের হাতে পিটানি খায়। তিনি বলতে চাচ্ছেন যে, নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে না পারলে তত্ত্বীয় নারীবাদের দরকার কি?

কিন্তু আমি ভাবছিলাম উল্টো করে। যিনি কষ্টে আছেন, তিনিই প্রতিবাদ করেন। নিজের জীবনে হোক না হোক, আরেকজনের জীবনে সমতার, অধিকারের আর সম্মানের নিশ্চয়তা পাওয়া যাক, এই চাওয়া থেকেও তো একজন নারী নিজে বঞ্চিত হবার পরেও গলা ফাটিয়ে অধিকারের কথা বলতে পারেন। হয়তো আর কিছু করতে না পারার এই অক্ষমতাই তাকে ফেইসবুক পেজে কিছু লেখার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের খাতা গল্পটা আমরা প্রায় সবাই পড়েছি। মেয়েটির খাতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, ওই খাতাটি তার কাছে কি ছিল তা বোঝার ক্ষমতা তার স্বামীর বা স্বামীর আত্মীয়দের ছিলনা।

আমাদের মেয়েদের অধিকাংশের কাছে কোন খাতা নেই যে খাতায় আমরা নিজেদের কথা লিখতে পারি; ‘যেমন ইচ্ছা লেখার আমার কবিতার খাতা’ আমাদের হাতে নেই বলে আমরা কি ফেইসবুকে লিখতে পারবো না যা বিশ্বাস করি বা করতে চাই? যা হওয়া উচিত ছিল কিন্তু হয়নি, যা আমার পাবার কথা ছিল কিন্তু আমি পাইনি আর আমি বিশ্বাস করি এতে আমার প্রতি অন্যায় হয়েছে এবং এটি যার প্রতিই হোক, অন্যায়ই আর আমি চাইনা এই অন্যায় সমাজে টিকুক, তাহলে আমি ফেইসবুকে আমার নিজের পেজে কেন লিখতে পারব না?

FB_IMG_1431803590252
উম্মে রায়হানা

ধরা যাক, আমার স্বামী আমাকে মারধোর করে, আমার বেতনের টাকা নিয়ে নেয় আর গুনে গুনে আমাকে রিকশা ভাড়া দেয়, আমাকে রেখে আরেক নারীতে আসক্ত কিংবা উপার্জনের পয়সা জুয়া খেলে উড়িয়ে দেয়, সংসার আমাকেই চালাতে হয়, তাকে ছেড়ে যাবার বাস্তবতা নেই বলে আমি সহ্য করে যাচ্ছি কিংবা অপেক্ষা করছি মওকা বুঝে একদিন শোধ তুলব, এই আমি যদি নারী স্বাধীনতার কথা বলি তাহলে তা বেমানান হবে? আমি কোন পুরুষের দ্বারা নিপীড়িত তাই?

আমরা যারা নিপীড়িত তারাই তো কথা বলবো, যিনি বা যারা কোনদিন বৈষম্য বঞ্চনা আর অত্যাচার দেখেননি তারা তো আর বলবেন না, তাদের কাছে তো এসব ‘অলীক’ বিষয়। আমরা সবাই কোন না কোন পুরুষের দ্বারা অত্যাচারিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত। বাবা ভাইকে আর আমাকে এক আদরে মানুষ করেছেন, তো দাদা এক আদর করেননি। ভাই সমান সম্পত্তি দিয়েছে তো স্বামী পাপোশ হিসেবে ব্যবহার করে। স্বামী মাথায় করে রেখেছে তো সহকর্মী ল্যাং মারতে চায়। বন্ধু বা সহকর্মী ভাগ্যও খুব ভাল, কিন্তু বাসে এক বুড়ো শকুন গায়ে হাত দিতে চায়। পাবলিক বাসে আমি চড়ি না, নিজের গাড়ি চালাই, ড্রাইভিং সিটে আমাকে দেখে টিপ্পনী কাটে লরিওয়ালা। আমাদের মধ্যে কে এসবের একটিও ভোগেনি?

আমরা সবাই ভুগি, আমরা সবাই জানি। যারা ভোগেননি তারা কেন বলবেন? ভুগেছেন আর এখনো ভুগছেন, তারা কেন বলতে পারবেন না?

আমার রুমমেটের মতন মেয়েরা জানবেনও না যে শিক্ষিত নারীও পুত্রসন্তানের আশায় তাবিজ নেন, পানিপড়া খান, আর যার বাড়িতে ভাই নেই সেও জানে না ভাইয়ের কাজ বোনকে করে দিতে হয় আর বোনের কোন কাজে ভাইকে প্রয়োজন হলে ভাই মুড দেখিয়ে বেড়ায়।

আমরা যারা আর কিছুই করতে পারি না, তারা অন্তত বলি, নিজে হালকা হবার জন্যই হোক আর ভার্চুয়াল প্রতিবাদের জন্যেই হোক।

যা ভুগেছি শৈশবে বা কৈশোরে, যা দেখেছি বিবাহিত হয়ে, অবিবাহিত থেকে, বিধবা হয়ে বা তালাকপ্রাপ্ত হয়ে, যা সয়েছি মা হয়ে, মা না হতে পেরে কিংবা না হতে চেয়ে, কন্যা জন্ম দিয়ে,যদিও তা স্বামীর বীর্যের কারণে, যা সইছি লেখাপড়া শিখে,বা না শিখে, উপার্জন করে বা না করে…

সকল নারীর প্রতি আমার আহবান,

আসুন আমরা বলি। কেউ শুনুক না শুনুক, উত্তর দিক না দিক। আমরা মুখ ফুটে বলি।

লেখক: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

শেয়ার করুন: