আয় তবে সহচরি, হাতে হাতে ধরি ধরি

girls 3ইশরাত জাহান ঊর্মি: এই সুপ্রীতিদিকে নিয়ে সত্যি পারা গেল না। সব জায়গায়, সব অন্যায় সংঘটনে তাকে প্রতিবাদ করতেই হবে, বড় সমস্যা তো দূর কি বাত, “সামান্য” অন্যায়ও সে সহ্য করতে পারে না। কাছের মানুষের বকা-ঝকা, রাগ-অভিমান, শাসন-ত্রাসন কোনকিছুতেই তাকে দমানো যায় না। সে কথা বলবেই। আমাদের যাদের শিড়দাঁড়া নেই, বহু শরীরেই নিজেদের মানাতে মানাতে-সে কিছুতেই সে দলে ভিড়তে পারলো না। নত হতে শিখলো না, কিভাবে বলতে হয় দলমান্য কথা-সে শিখলো না। তারে নিয়ে আমরা বড়ই বিপদে আছি।

কোথায় সেজে-গুজে সুখী সুখী চেহারার ছবি পোস্ট করবো, বেড়াতে-টেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করবো, তা না সারাক্ষণ এই মেয়েটি আমাদের খুঁচিয়ে যাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা মনে করিয়ে দেবে, অভিজিৎ হত্যার কথা মনে করিয়ে দেবে, ওয়াশিকুর হত্যার কথা মনে করিয়ে দেবে, বিজয় অনন্ত দাশকে কোপানোর কথা মনে করিয়ে দেবে, বর্ষবরণে নারী নির্যাতনের কথা মনে করিয়ে দেবে…মনে করাতেই থাকবে। আমাদের ঘুমন্ত অথবা প্রায় মৃত বিবেকের গালে চটাচট বিরামহীন থাপ্পড় লাগিয়ে যাবে।

তিনদিন ছিলাম না ফেসবুকে। ফিরে এসে কিছু কিছু পড়লাম, কিছু বুঝলাম। সুপ্রীতিদি আর তার মেয়েকে তো সাইবার নির্যাতন করা হয়েছে অনেক আগে থেকেই, এখন এই ঘটনার প্রতিবাদ যারা করছেন তাদের ধরা হচ্ছে ধীরে ধীরে। কসাই যেমন দক্ষতার সাথে আয়েশ করে মাংশ কাটেন (সেটা তার পেশা) সেরকমই সুপ্রীতিদির উপর সাইবার সন্ত্রাসের প্রতিবাদকারীদের জঘন্য নোংরা সব বাক্যবাণে কাটা হচ্ছে। চাপাতির কোপটা কেবল বাকী। অসুবিধা নেই, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেটাও হয়ে যাবে।

আমরা অধিকাংশই চুপ করে আছি। মান-সম্মানের ভয় আর চাপাতির কোপ দুটোর ভয়ই আমাদের বিদ্যমান। তাই নিরাপদ দূরত্বে থেকে লাইক মারছি। এসবে তেমন একটা হেল-দোল নেই আমাদের। রিকশায় চলা-ফেরা করেন মহিলা, কোনদিন চাপতি দিয়ে কুপিয়ে-টুপিয়ে দিলে আমরা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বলে-টলে স্ট্যাটাস দেবো, অসুবিধা নাই।

কাল সন্ধ্যার একটা ঘটনা শুধু মনের ভেতর খোঁচাচ্ছে। ডে-অফ ছিল। মেয়ে আর একবন্ধু কাম ভাইয়ের বউকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা চিন্তা করি। সময় বেশি নাই, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ভাবলাম কাছেই কোথাও যাই। মোহাম্মদপুর বাঁশবাড়ী দিয়ে সোজা এগুলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় একটা পুরনো মসজিদ আছে। সাতগম্বুজ মসজিদ নাম। যাওয়া-আসার পথে অনেকবার দেখেছি, মসজিদের সঙ্গে লাগোয়া সবুজ বাগানে বাচ্চাদের খেলতে দেখেছি। পুরনো স্থাপনার প্রতি আমার আগ্রহ ছোটবেলা থেকে। ইচ্ছে ছিল মসজিদটা দেখবো, আমার বাচ্চাটা সবুজ বাগান একটু দৌড়াবে-খেলবে।

আমরা গেলাম। জায়গাটা কেমন অদ্ভুত। টুপি পড়া অদ্ভুতদর্শন (টুপি পড়লেই কেউ অদ্ভুত দর্শন হননা, আমাদের সবার পরিবারেই টুপি পড়া মানুষ আছেন। কিন্তু এই লোকগুলোকে আমার আসলেই অদ্ভুত লাগছিল, মনে হচ্ছিল যেন বাংলাদেশের নয়, অন্য কোন দেশের পরিবেশে এসে পড়েছি।) কতগুলো ছেলে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে, কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ।

একটা লোক বাগানের সাথে লাগানো গেটটা খুলে দিল। আমরা মসজিদ থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। জাস্ট দুই মিনিট। বয়স্ক একটা লোক এসে খুব কড়া স্বরে বলল, এখানে কি? যান, মেয়েমানুষ ঢোকা নিষেধ।

আমরা কথা বাড়ালাম না। চলে এলাম। আমার মেয়েটা করুণচোখে বাগানের দিকে তাকিয়ে বলল,

: ময়না, আমাদের ঢুকতে দেবে না?

আমার তিন বছরের বাচ্চাটা। ওকে কি করে বুঝাই যে, মা, আমরা যে মেয়েমানুষ।

সুপ্রীতিদির উপর সাইবার নির্যাতনের সাথে এই ঘটনার কোন সম্পর্ক নাই। শুধু ভাবছি, আমরা সাজানো-গোছানো ঘরে বসে থেকে ভাবি সবকিছু বুঝি পাল্টে গেছে। জঞ্জাল বুঝি পরিষ্কার হয়ে গেছে, কিন্তু, সহচরীরা হাতে হাত রাখার সময় যে এখুনই। আমরা কি তা বুঝতে পারছি?

লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন: