জুলেখারা নিজে বাঁচে, অন্যকেও বাঁচায়

JulekhaCaptureউইমেন চ্যাপ্টার: মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল জুলেখার। পুরো নাম জুলেখা বেগম। তখন সে পড়তো ক্লাস ফাইভে। আর এখন তার ৩৫ বছর বয়স।

অল্প বয়সেই তিন-তিনটি সন্তানের জন্ম দেয়ার পর স্বামী তজিবর রহমান তাকে ছেড়ে চলে যায়। শুরু হয় জীবনের এক সংকটময় অধ্যায়। কিছুদিন শ্বশুর বাড়িতেই ছিলেন এরপরও। কিন্তু তখন আমাকে প্রতিনিয়তই অবহেলা এবং নানা ধরণের অপমানজনক কথা এবং এক পর্যায়ে তার ওপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতনও। অবশেষে সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন জুলেখা।

দরিদ্র বাবার মেয়ে জুলেখা। তিনটি সন্তানসহ বাড়তি চারটি মুখের খাবার জোগানো বাবার পক্ষে অসহনীয়ই ছিল। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। নিজেই এগিয়ে আসে জুলেখা। কৃষিকাজ শুরু করেন। বাবার দেওয়া মাত্র দেড় বিঘা জমি নিয়ে শুরু হয় তার জীবনের পথচলা।

কিন্তু প্রাথমিকভাবে কোনো সঞ্চয় না থাকায় চাষাবাদ করাও কঠিন হয়ে উঠে। আত্মীয়-স্বজনসহ অনেকের কাছে টাকা ধার চান জুলেখা। কিন্তু আমার কোন সম্পত্তি না থাকার কারণে কেউই তাকে ধার দিতে রাজি হচ্ছিল না।

উনি তখন তাদের বোঝাতে সক্ষম হন যে, কঠোর পরিশ্রম করে একদিন তিনি সফল হবেনই। তখন এক প্রতিবেশী তাকে কিছু টাকা ধার দেয়।

সেই টাকা দিয়ে প্রথমে অর্ধেক জমিতে ধান এবং বাকি জমিতে আলু ও সরিষা চাষ করের। প্রথমবারে যে পরিমাণ ধান পেয়েছিলেন, তা দিয়ে মোটামুটি ছয় মাস চলে। অন্যদিকে আলু এবং সরিষা বিক্রি করে কিছু ধার শোধ করেন। কিন্তু  বাদ সাধে প্রশিক্ষণের অভাব। কৃষিকাজে কোন প্রশিক্ষণ না থাকায় খুব বেশি লাভের মুখ তিনি দেখছিলেন না।

এরপরে আবার পরের বছর চাষাবাদের জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন। সেই পরিকল্পনা করতে আমাকে সাহায্য করেন তার মা।

মা আর জুলেখা মিলে হিসেব করে বের করেন যে, জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতে পারলে বেশ লাভ করা সম্ভব। গ্রামের ইসহাক চাচারই জমি অনেক। তার কাছ থেকে কিছু জমি নিতে পারলে স্বপ্ন পূরণ হয়। এসব কথা ভেবেই মা-মেয়ে মিলে সেই চাচার বাড়িতে যান জুলেখা। প্রথমে শুনে ইসহাক চাচা আমলেই নিলেন না তাদের প্রস্তাব। পরে জুলেখার মা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজী করালেন।

উনার কাছ থেকে ১০ কাঠা জমি ৬০-৪০ শতাংশ হিসেবে বর্গা নিয়ে আখ চাষ শুরু করেন। পাশাপশি নিজের জমিতে ধান, আলু ও সবজি চাষও চললো। সেই বছর ফলন বেশ ভালো হলো। নিজের জমির ধান, আলু দিয়ে সংসারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করেন। সেই বছর তার মোট লাভ হয় ৮,০০০ টাকা।

জুলেখা বলছিলেন, জমি বর্গা নেয়ার আগে এলাকার মানুষজন তাকে অনেক ধরনের কথা বলেছিল। চাষাবাদের পরামর্শ চাইলে তারা কেউ কেউ বলেছিল মেয়ে হয়ে কীভাবে চাষাবাদ করবে, কেউ কেউ আবার এ নিয়ে উপহাসও করেছিল।  কিন্তু জুলেখার কণ্ঠ অনেক ঋদ্ধ শোনায়, যখন তিনি বলেন, বছর শেষে এই মানুষগুলোর মুখই বন্ধ হয়ে যায় তার সাফল্য দেখে।

এমনও হয়েছে, গ্রামের অনেকে তখন তার সাফল্যে ঈর্ষা বোধ করেন। মজার ব্যাপারটা হলো, যে ইসহাক চাচা প্রথমে তাদের জমি বর্গা দিতে চাইছিলেন না, সেই তিনিই পরের বছর তার দুই বিঘা জমি বর্গা নিতে বলেন। সেই বছরেও জুলেখার সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মতো।

সেই বছর তার আয় হয় প্রায় ৩০,০০০ টাকা। এবার আরেকটু সাহসী হয়ে উঠেন জুলেখা। নিজের ওপর বিশ্বাস জন্মে। আগের বছরের জমানো টাকা থেকে ৫,০০০ টাকা নিয়ে এবং এই বছরের ৩০,০০০ টাকাসহ সর্বমোট ৩৫,০০০ টাকা দিয়ে পরের বছর একটা আমবাগান দুই বছরের জন্য ইজারা নেন। প্রথম বছরেই মূল টাকা উঠে চলে আসে। পরের বছর ২৫,০০০ টাকা লাভ হয়।

এভাবে টাকা জমতে শুরু করে। নিজের জমির ফসল দিয়ে সংসারের চাহিদা মেটানোর পরও যে টাকা থাকে, তা দিয়ে দিয়ে নতুন করে নিজের নামে ৫ কাঠা জমি কেনেন। এই জমিটি বর্গা না দিয়ে নিজেই চাষ করেন। মা-মেয়ে দুজনে মিলে খেটে গড়ে তোলেন নতুন স্বপ্ন।

এদিকে জুলেখার ছেলের শরীরেও লম্বা টান পড়ে। গায়ে-গতরে বেড়ে উঠতে থাকে, স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন জুলেখা। কৃষিকাজে সাফল্য, সন্তানের পড়াশোনা, এভাবেই ধীরে ধীরে তার ভাগ্য পরিবর্তন হতে থাকে। এর মধ্যে দুই মেয়েকেও লেখাপড়া শিখিয়ে ভাল জায়গায় বিয়ে দিয়েছেন।

জুলেখা জানান, একসময়ে নি:স্ব, সহায়-সম্বলহীন জীবনে এখন তার প্রায় ৮ বিঘা জমি। নিজের কষ্ট তো দূর হলো, তাই এখন চান আশপাশের অন্য মেয়েদেরও স্বাবলম্বি করতে। চেষ্টা করেন এলাকার দুঃস্থ, গরিব, বিধবা মহিলাদের সাহায্য করতে, তাদের ভাগ্যে পরিবর্তন আনতে।

এতোদূর এসেছেন কোনরকম সরকারি সাহায্য ছাড়াই। তবে তিনি জানেন, গ্রামের মেয়েদের কৃষিখাতে প্রশিক্ষণ বা সরকারি ঋণ-এর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কোথায় দেয়া হয়, কবে দেয়া হয়, কিভাবে দেয়া হয়, এতোকিছু আর জানা হয়ে ওঠেনি।

জুলেখার বক্তব্য হলো, “আমি মনে করি যে, যদি মেয়েদের ছোট করে না দেখা হয়, তারা যা পারে সেটাকে যদি অসম্মান না করা হয় এবং তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় তবে তারা নিজেদের, পরিবারের, এমনকি এলাকা ছাড়িয়ে দেশেরও অনেক উপকারে আসবে। আর এটা সম্ভব হলে কৃষিনির্ভর এই দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে খুব বেশি সময় লাগবে না”।

তথ্যসূত্র: অক্সফাম

শেয়ার করুন: