তাছলিমা তিন্নি: যুগের পরিবর্তন শব্দটির সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচিত আমি। পরিবর্তনের ইতিবাচক ব্যাখ্যা হলো সামনের দিকে এগিয়ে চলা। উন্নয়নের পথে যাত্রা (অর্থনীতির ভাষায়)।
কিন্তু হঠাৎ করেই শব্দটা যেন অচেনা ঠেকছে। বাড়ি থেকে বের হতেই চোখে পরে হিজাব পরা শিশু, কিশোরী, তরুণী এবং মাঝ বয়সী নারী।
স্কুলগুলোতে ঢুকলে চোখে পরে ৫০ ভাগের বেশী মেয়েরা হিজাব পরছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত একটি স্কুল। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে মাঝে মধ্যেই যাওয়া হয়। সেখানেও একই চিত্র চোখে পড়ে। জানার কৌতূহল থেকে কয়েকদিন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাও করেছি। উদ্দেশ্যমূলক কোন কারণ আমাকে কেউ বলতে পারেনি।
কেউ বলেছে, নিরাপত্তার জন্য, কেউ বলেছে ফ্যাশন, আবার এমনটাও বলেছে ধর্মে আছে, ধর্মীয় বিধান মেনে চলছি। আমার মা সত্তরের দশকে কলেজে পড়তেন।
মাকে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আম্মা তুমি যখন কলেজে পড়তে নিশ্চয়ই বোরখা পরে যেতে হতো’। আম্মা আমার কথা শুনে অনেকটা হতবাক হলেন। বললেন, এ কাহিনি তুই কোত্থেকে আবিস্কার করলি? বলেছিলাম, আমি আসলে একটা কম্পারিটিভ এ্যানালাইসিস থেকে বলছি।
মা এর কাছ থেকে যে ধারণা পেলাম, তারা শাড়ি পরে কলেজে যেতেন ছেলে-মেয়ে একসাথে। এমনকি মাথায় আঁচল টেনেও নেননি। যুগের পরিবর্তন শব্দটা এজন্যই আমার কাছে আজ অচেনা।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি তবে পরিবর্তন ইতিবাচকের দিকে যাচ্ছি? না পেছনে ফিরছি!
আপনারা মোটেও ভাববেন না আমি হিজাব বিরোধী । কিংবা ধর্মকে অবমাননা করতে চাইছি। আমার দ্বন্দটা একটা জায়গায়।
ধর্মের নাম দিয়ে কিংবা নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এরকম একটি বিষয় কেন আমরা এই প্রজন্মের উপর চাপিয়ে দিচ্ছি? ধর্মের ব্যাখ্যা থেকে যদি এই শিক্ষা দেই তবে অবশ্যই প্রতিটি বিষয়ে তাদের জানাতে হবে।
শুধুমাত্র হিজাব নয়। হিজাব পরে এমন অনেককে প্রশ্ন করেছি, তোমরা নামাজ পড়ো? রোজা রাখো? উত্তরে ‘না’ পেয়েছি। শুধু হিজাব দিয়ে ধর্ম অনুসরণ কি করে হয়? বোধগম্যতায় আসেনি। হিজাব পরা অথচ হাতে-পায়ে নেলপলিশ দেয়া অনেক নারীকে দেখি। ইসলাম ধর্ম মতে নেলপলিশ তো হারাম। এখানে নিজের সাথেই নিজের দ্বন্দ্ব নয় কি?
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যারা হিজাব পরে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি। হিজাব কি কখনও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে? তবে আমাদের মা-খালারা কি করে একটা সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থানে থেকে লেখাপড়া করেছেন? মায়ের কাছে গল্প শুনে এবং ছোটবেলা থেকে দেখে আসা পারিপার্শ্বিকতা থেকে আমার মনে হয়েছে মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিত্ব এ দুটো বিষয়ের সমন্বিত চর্চা একটি মেয়েকে সবচেয়ে বেশী নিরাপত্তা দিতে পারে।
পর্দা যদি নিরাপত্তা দিতে পারতো তবে দু’বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হতো না। সন্তানদের মূল্যবোধের শিক্ষা না দিয়ে, ছোটবেলা থেকে ব্যাক্তিত্বের চর্চায় উদ্বুদ্ধ না করে আমরা তাদের কোন ব্যাখ্যা ছাড়াই হিজাব চাপিয়ে দিচ্ছি।
কোন প্রশ্ন নেই ঐ শিশুর মনে। কেন তার জন্য মাথা ঢেকে রাখার বাধ্যবাধকতা? কাজের খাতিরে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে আমাকে। অনেক রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। মোকাবেলা করে এসেছি কৌশল খাটিয়ে। আমার কখনো মনে হয়নি ঐ ধরনের সমস্যা থেকে পর্দা আমাকে রক্ষা করতে পারতো।
পরিচিত এক মেয়ে। বর্তমানে ক্লাশ টেন এ পড়ে। সে ক্লাস এইট থেকে হিজাবে অভ্যস্ত। কিন্তু শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়ার সময় হিজাব ব্যবহার করে। পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে তাকে দেখেছি জাঁকজমকপূর্ণ সাজে। একদিন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাকে জিজ্ঞ্যেস করেছিলাম, ‘তুমি আজ হিজাব পরোনি কেন’? তার বাবা-মা আমার উপর অনেকটা রেগে গিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য, হিজাব পরে বাইরে চলে বলে আমাদের মেয়েকে সবাই ‘ভদ্র’ বলে। রাস্তাঘাটে সকলেরই শালীন হয়ে চলা উচিত।
তাদের কথা থেকে যতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র রাস্তায় বের হওয়ার সময় হিজাব পরতে হয়। আরো একটা বিষয় আমার অনুধাবন হয়েছিল। তারা আমাকে কিছু একটা বলারও চেষ্টা করছিলেন। কারণ আমি হিজাব পরি না।
খটকা লাগলো। এ কেমন মতাদর্শ দিয়ে তৈরি করছি আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। যার ব্যাখ্যা আমাদের নিজেদের কাছেই নেই। কাদের দেখে আমরা উৎসাহিত হচ্ছি? একটু ভেবে দেখা দরকার নয় কি? আজ কেন যেন এর প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভব করছি আমি। উদ্দেশ্যবিহীন কোন লক্ষ্য হতে পারে না। উদ্দেশ্য থাকতে হবে এবং সেই উদ্দ্যেশ্যের ভীত হতে হবে শক্ত। ভীত ছাড়া কোন ইমারত টেকে না। ভীতহীন যে উদ্দেশ্যের বীজ আমরা আমাদের সন্তানদের ভেতর বপন করছি, তার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারছি না। নিজের প্রতিবিম্বের সাথেই একদিন দ্বন্দ্ব তৈরি করবে আমাদের সন্তানেরা।
মানবাধিকার কর্মী