সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম: হাজার বছরের মতো এখনো পুরাকীর্তির দেশ নেপালে প্রতিদিন ভোর আসছে একই রকম করে। শুধু ভেতরটা বদলে গেছে সমূলে। মিশে গিয়েছে হাজার বছরের লালিত সেই ঐতিহ্য। ‘তবুও তো প্রাণ জেগে উঠে’র মত এমন বিপর্যয়ের মুখেও যখন দু-একটা করে জীবিত প্রাণ উদ্ধারের খবর পাওয়া যাচ্ছে আমরা ভেতরে-ভেতরে জীবনের জয়গানে আনন্দে কেঁপে উঠছি।
ভূমিকম্পের ২২ ঘণ্টা পর কাঠমান্ডুর কাছে ভক্তপুরে একটি ধ্বংসপ্রায় ভবনের ভেতর থেকে তেমনি বিস্ময়ে ফিরে এসেছে সোনিত ওয়াল নামে চার মাসের এক শিশু। নেপালের সামরিক বাহিনী উদ্ধার অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরেই আসছিলেন ঠিক এমন সময় ভেতর থেকে কান্নার ক্ষীণ শব্দ পেয়ে আবার ফিরে যান ওই ধ্বংসস্তুপের কাছে। এবার তাঁরা বের করে আনেন সুনীতকে।
শীতের কাপড় গায়ে সুনীতের সাদা জামা মাটিতে ভরে আছে, ধুলোর আস্তরণ ছোট্ট হাতের মুঠোয়, চোখ খুলতে পারছে না। কিন্তু তাতে কি প্রকৃতির বিপর্যয়ের কাছেও জিতে এসেছে বলেই তার মুখের হাসি স্পষ্ট। মানব শিশুর এমন প্রাণ অলৌকিক বললে বেশি বলা হয় না।
উদ্ধারের এই গল্পটা এই শিশুটির জীবনে থাকবে, কিন্তু স্মৃতিতে নয়। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে তাকে যখন উদ্ধার করা হয় তিনি এমন একটা ভাব নিয়েছেন, যেন তার এইমাত্র ঘুম ভাঙলো। চার মাসের এই শিশুর কিছুই মনে থাকবে না কিন্তু আশ্চর্য এক জীবন অপেক্ষা করছে তার জন্য। আজীবন গল্প শুনবে, ছবি দেখে কল্পনায় মেলাতে চেষ্টা করবে কেমন ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সেই ভূমিকম্প। সিএনএন শিরোনাম দিয়েছে মিরাকল বেবি। আর আমার বাবা ছবি দেখে বলছেন ‘পাথর ফেটে জন্মানো শিশু ‘।
নেপালের গণমাধ্যম ‘কাঠমান্ডু টুডে’ সুনীতকে উদ্ধারের তিনটি ছবি প্রকাশ করেছে। একটি ছবিতে তাকে দেখা যাচ্ছে, উদ্ধারকর্মীরা আলোর দিকে তুলে ধরেছেন, আরো খানিকটা আকাশের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাঁরা যেন বলতে চাইছেন, এরই নাম জীবন।
আশার কথা হচ্ছে অলৌকিক বেঁচে থাকা শিশুর শরীরে বড় কোন ক্ষত বা আহত হওয়ার চিহ্ন নেই। এমন আরো কয়েকটি প্রাণের খবর পাওয়া গেছে কাঠমান্ডুতে। তবে প্রাণ ফিরে পাওয়া এসব মানুষের অধিকাংশ হারিয়েছে তাদের পরিবার। কেউ কেউ আটকা পড়ে আছেন একই জায়গায়। তারা জানেনও না তাদের পরিবারের খবর। প্রিয় সন্তানটি বেঁচে আছে কিনা সে খবরও জানার উপায় নেই এখন নেপালে।
এমনই একজন মধু বঁদু। ইন্ডিয়ান এনডিটিভি বলছে, ভূমিকম্পের মুহূর্তে কাঠমান্ডুতে আটকে পড়া এই মানুষটি তিনদিন চেষ্টা করেও পৌঁছাতে পারেননি শহরের পাশের গ্রামে পরিবারের কাছে। তারা আদৌ কেউ আছেন কিনা তাও জানেন না মধুর মতো অনেকে। এমন করে বেঁচে থাকা আরেক মৃত্যুরই মতো। শনিবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরও প্রায় ৭০ বার কেঁপে উঠেছে নেপাল। আর সে দেশের বেঁচে থাকা মানুষের যে ভিত নড়ে গিয়েছে সার্বিকভাবে, তা হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবেন না এক জীবনে।
ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে গলিত-বিকৃত সব মরদেহ। সময় যত যাচ্ছে কমে আসছে জীবিত মানুষ উদ্ধারের সংখ্যা। সরকার ও বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো সাহায্য যতটা সম্ভব পাঠানো হচ্ছে সব হারানো মানুষগুলোর কাছে, কিন্তু প্রকৃতির বৈরিতা কিছুতেই থামছে না। এমনকি এই মুহূর্তে সাহায্য প্রয়োজন হলেও অন্য দেশ থেকে মানুষ যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে নেপাল সরকার।
গুর্খার মতো প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টি, ভূমিধসের কারণে সাহায্য পৌঁছানো খুব একটা সহজ হচ্ছে না। হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন এখন তাঁবুর নিচে। বিদ্যুত নেই, খাবার নেই, মাথার উপর আকাশ ছাড়া আচ্ছাদন নেই, এমন মানুষজন কি করে বেঁচে থাকেন একমাত্র ইতিহাসই হয়তো তাঁর সাক্ষী হয়ে থাকে। উদ্ধার কর্মীরা বলছেন, সহজ নয় এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা।
জাতিসংঘের হিসেবে এবারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৮০ লাখ মানুষ। ১৯৫২ সালে হাওয়াই দ্বীপে ৯ দশমিক ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা ছিলো ১৫ হাজার। ১৯৬৪ তে ৯ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছে ১২৮ জন। ২০০৪ সালে সুমাত্রায় ভূমিকম্পে প্রায় ২ লাখ এবং ২০১১ সালে জাপানে সুনামি ও ভূমিকম্পে মারা গেছে ১৮ হাজার মানুষ, কিন্তু নেপালে এবারের ভূমিকম্প তাদের গত ৮১ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে প্রাণহানির। এ সংখ্যা এখন সরকারি হিসেবেই পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে, কিন্তু উদ্ধারকর্মীদের আশংকা, এ সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
নেপালের এমন ভয়াবহতার কারণে গুরুত্ব হারিয়েছে একই ভূমিকম্পে চীনে ২৫ জন এবং ভারতের বিহারে ৭০ জনের মৃত্যুর খবর। প্রকৃতি যখন বৈরি হয় তখনই প্রমাণ পাওয়া যায় তার কাছে কোন ধর্মের ভেদাভেদ নেই। মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা একই রকম করে মিশে গিয়েছে মাটির সাথে। আর তাঁবুর নিচে থাকা পরিবার-স্বজন হারানো, শরীরে ক্ষত, মনে আতংক, খাবার নেই, পানি নেই যে মানুষগুলো, তাদের মাঝেও এই মুহূর্তে নেই কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ। তারা একই রকম ক্ষত বহন করে বেঁচে আছেন, এটাই তাদের একমাত্র পরিচয়।
সাংবাদিক ও লেখক