মানসিক দৈন্যই আমাদের শত্রু

Draupodi 3জান্নাতুল মাওয়া: গত পহেলা বৈশাখে ছিলাম খাগড়াছড়ির বৈসাবি উৎসবে। সেখানে মারমা, ত্রিপুরা আর চাকমারা একসাথে সাংগ্রাই, বৈসুক আর বিজু উৎসব পালন করে, আর তিনটি মিলে একত্রে নাম হয়েছে বৈসাবি। এই উৎসব গুলোর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে মজা লেগেছে সাংগ্রাইয়ের পানি উৎসব।

মারমারা নববর্ষের উৎসব করে একে অন্যের গায়ে পানি ছিটিয়ে দিয়ে। সেদিন ছিল দারুণ গরম। যেদিকেই যাচ্ছি পানির ছিটে এসে গায়ে লেগে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। মূল উৎসবের জায়গায় গ্যালন গ্যালন পানি সাপ্লাই দেয়া হচ্ছিল, সেখানে প্রচুর ভিড়, ছেলে-মেয়ে সবাই একে-অন্যের গায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে। আমরা একেবারে ভিড়ের মাঝখানটায় পড়ে গেলাম একবার। কিন্তু একটাবারের জন্যেও নিজেকে অরক্ষিত মনে হয়নি। এত্ত ভিড়েও কেউ কারো ওড়না ধরে টান দেয়নি। পাহাড়ি মেয়েদের তো ওড়নাই পরতে হয় না!

যেই আমি পাহাড়ে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে পেরেছি সেই আমি নিজের চিরপরিচিত এই সমতলে ভিড় এড়িয়ে চলি, দৈব-দুর্বিপাকে ভিড়ে পড়লে নিজেকে ভীষণ অরক্ষিত মনে হয়। কারণ পাহাড়ের মানুষ এখনো আমাদের চেয়ে অনেক সভ্য। যেই গোবর ভর্তি মস্তিষ্কের লোকেরা এখনো মনে করেন, ‘বর্ষবরণের ভিড়ে নারীরা কেন যায়’ তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্ষ বরণ উৎসবে নিয়ে যাওয়া উচিত। সেখানে গিয়ে দেখে আসুন সভ্যতা কাকে বলে। কিছুটা সভ্যতা-ভব্যতা যদি শিখে আসতে পারেন তো আমরা বেঁচে যাই।

এই ১৩ তারিখেই গারডিয়ানে পড়লাম ৬৫ টি দেশের মানুষের মধ্যে একটি জরিপে উঠে এসেছে বাংলাদেশের ৯৩ ভাগ মানুষ নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি করে। গ্লোবাল র‌্যাংকিংয়ে ধার্মিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে প্রথম সারিতে। কিন্তু আমাদের ধর্মবোধ আমাদের রিপুকে দমন করতে পারেনি। ভিড়ের মধ্যে আমাদের হাত নিশপিশ করে। লোকাল বাস, বাজার, ব্যাঙ্ক, উৎসব, মেলা; যে কোন ধরনের পুরুষ (পড়ুন পশু) সংকুল স্থানে আমাদের নারীরা নিজেদেরকে চরম অনিরাপদ মনে করে। কিছু হলেই মুখস্থ কথা, নারীরা যায় কেন? আপনারা কী বলতে চান, মেয়েরা কি ঘরের মাচায় উঠে বসে থাকবে সারা জীবন?
আমরা আবার দোহাই দেই অশিক্ষার আর দারিদ্রের। আসলে দোষ কিন্তু অশিক্ষার না, দোষ হল কুশিক্ষার। দোষ আমাদের পকেটের দারিদ্র্যের না, দোষ হল আমাদের মানসিক দীনতার। এই মানসিক দারিদ্র্যই আমাদেরকে অত্যাচারিত আর অত্যাচারীকে একই অবস্থানে নিয়ে আসে, কুৎসিত দাঁত বের করে আমরা হাসতে হাসতে বলতে পারি, ‘ভালো হইসে, ওইখানে গেসে ক্যান। এদের উচিত শিক্ষা হইসে’।
যেই শিক্ষা আমাদেরকে শিখিয়েছে যে মেয়েরা বন্ধু না, সহযাত্রী না, সহকর্মী না, সহপাঠী না, সিনিয়র না, জুনিয়র না, মেয়ে মানেই ভোগ্য বস্তু, সেই শিক্ষাই আমাদেরকে উৎসবের দিনে মেয়েদের ওপর চড়াও হতে উস্কে দেয়।
অনেক আলাভোলা লোককে বলতে শুনছি, যারা খারাপ তারা কি নীতি কথা শুনবে? কিংবা অনেকে বলছেন, যারা এই অপকর্ম করেছে তারা আসলেই জানোয়ার, এখন জানোয়ারদের সাথে তো আর পারা যাবে না, তাই মেয়েদের উচিত ঘরে দরজা জানালা আটকে বসে থাকা।

আপাতদৃষ্টিতে আপনাদের কথাগুলো শুনতে ভালো মনে হলেও আপনাদের এই দুর্বল অবস্থানটাই খারাপকে উস্কে দেয়। আপনাদের এসব কথাতেই নোংরা পশুর পাল মনে করে পৃথিবীটা ওদের, মেয়েরা কোন রকম তাদের দয়ায়, তাদের জন্যে বেঁচে থাকবে। তারা যতটুকু আনন্দ করতে দিবে ঠিক ততটুকুই করবে।

মেয়েরা ঘরে বসে থাকবে, মেয়েদের জীবনে কোন রং থাকবে না। বাইয়ারাই আলো বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। আনন্দ উৎসব করবে। কারণ খারাপ লোকেদের নাকি ভালো করা যায়না। আজকে উৎসবে যেতে নিষেধ করছেন, কাল বলবেন কাজে যেও না , বাজারে যেও না, কলেজে যেও না , স্কুলে যেও না। কারণ খারাপ লোক তো সব জায়গাতেই আছে!
একদিন এভাবে হয়তো পুরো দেশটা একটা সাফারি পার্কের মত হয়ে যাবে, যেখানে জানোয়াররা ঘুরে বেড়াবে, আর মানুষেরা জেলখানায় বসে থাকবে!

বিঃ দ্রঃ- আপুরা, আগামীবার আরো দলে দলে বের হবেন। এদেরকে কোনভাবেই জয়ী হতে দেয়া যাবে না, কোনভাবেই না!

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.