ভাগ্য পরিবর্তনে নীপার ভেষজ বাগান

Nipa1উইমেন চ্যাপ্টার: ভেষজ বাগান করে নীপার ভাগ্যটাই যেন বদলে গেছে। তার দুই মেয়ে আঁখি ও মিম যখন বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হয়, দুই বোনের পরনে সুন্দর ধবধবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়। পিঠের উপর ঝোলানো ব্যাগ। ব্যাগে বই, খাতা, কলম, টিফিন বক্স ও পানির বোতল। ওদের দেখে গ্রামের লোকজন বলাবলি করে, এরা আগে কি ছিল, আর এখন কি হলো ! একেই বলে ভাগ্য। ওরা এখন ভেষজ বাড়ির মেয়ে। এটাই প্রধান পরিচয় ওদের।

নাম :  নাজনীন আক্তার নীপা
স্বামীর নাম  :  আইয়ুব আলী হালদার
কৃষি জমির পরিমাণ :  ১০ কাঠা
উৎপাদিত ফসল :  লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়স ও টমেটো ইত্যাদি
অঞ্চল : কাতিয়ানাংলা, খুলনা
সহযোগিতাকারী সংগঠন: লোকজ

(খুলনা বিভাগে নির্বাচিত কৃষাণী)
খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার কাতিয়ানাংলা গ্রামের নাজনীন আক্তার নীপার পরিবারটি এখন ভেষজ বাড়ি নামে পরিচিত। তার বাবা দরিদ্র হলেও এইচএসসি পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন কাতিয়ানাংলা গ্রামের আইয়ুব আলী হালদারের সাথে।

সাত বছর আগের কথা, তখন সেই সংসারে ছিল প্রচণ্ড অভাব। দরিদ্র স্বামীর অভাবী সংসারে সম্পদ বলতে নাড়া ছাউনী যুক্ত ছোট কুঁড়েঘর, বসত ভিটা ও ধানী জমিসহ দুই বিঘা জমি এবং স্কুল পড়ুয়া দুটি মেয়ে আঁখি ও মিম।

জমি -ভিটা অনাবাদি থাকায় তাদের আয় ছিল না মোটেই। বড় মেয়ে আঁখি তখন চতুর্থ শ্রেণির ও মীম প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলে যাওয়ার জন্য দুবোনের পিঠে ব্যাগ তো দূরে থাক, ঠিকমত বই-খাতা, কাগজ-কলমও জুটতো না। কিন্তু ওদের পড়ানোর জন্য মরীয়া ছিলেন নীপা।

সংসারে ক্রমাগত অবনতি হওয়ায় তিনি সারাক্ষণ এই অবস্থা পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। কিন্তু তার স্বামীর কোন জীবিকা না থাকায় কিছুতেই অভাব যেন কাটছিল না।

Nipa
বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত নীপা

হঠাৎই একটা বুদ্ধি এলো নীপার মাথায়। ২০০৭ সালে তিনি নিজের উদ্যোগে বাড়িতে একটি একটি করে ভেষজ গাছের চারা রোপণ করতে থাকেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘লোকজ’ এর গ্রামীণ নারী দলের বিভিন্ন সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করাও শুরু করেন।

২০১০ সালে নীপা ও তার স্বামী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘লোকজ’ থেকে  জৈব পদ্ধতিতে আঙিনায় সবজি চাষ ও ভেষজ বাগানে সচেতনতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ নেন। এর পর দুইজনে মিলে ১০ কাঠা জমিতে জৈব পদ্ধতিতে লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়স ও টমেটোর চাষ করেন। পাশাপাশি ভেষজ বাগানটিকে আয়ের উৎস হিসাবে বেছে নেওয়ার চিন্তায় দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ভেষজ চারা সংগ্রহের ওপর জোর দেন।

দিন দিন আয় বাড়তে থাকে। আয়ের একটি অংশ ভেষজ বাগানের পিছনেও ব্যয় করতে থাকেন। পরবর্তী বছর সবজি চাষের মাধ্যমে আয় হয় ৭০ হাজার টাকা। পাশাপাশি এক বিঘা জমিতে পরিবেশসম্মত সমন্বিত মৎস্য চাষ (ধান ক্ষেতে মাছ চাষ) এর মাধ্যমে আয় হয় ৪০ হাজার টাকা। এই টাকা থেকে পারিবারিক খরচ ও মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে প্রাথমিক ভাবে বাড়ির সামনে ২৫ শতাংশ জমিতে বেশ কয়েকটি দূর্লভ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদের চারা রোপন করেন। কিন্তু  গরমের মৌসুমে সেচের পানির সংকট হওয়াতে বেশ বিপাকে পড়ে যান এই দম্পতি।

এই অবস্থা দেখে ‘লোকজ’ ২০১১ সালে নীপার পরিবারকে ৫০০০ (পাঁচ হাজার) টাকা আর্থিক অনুদান দেয় এবং স্বামী আইয়ুব আলী হালদার স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহায়তায় বাড়ির আঙিনায় একটা গভীর নলকূপ স্থাপন করেন। এর ফলে বাগানটা রক্ষা পায়।

বর্তমানে নীপাদের বসত ভিটার ১০০ শতাংশ জমিতে রয়েছে প্রায় ৮০০ প্রজাতির  ১১৮০টি ভেষজ উদ্ভিদ। সম্পূর্ণ বাড়ি বিভিন্ন প্রজাতির ভেষজ গাছ আর লতা-পাতায় ভরে উঠেছে। এইসব উদ্ভিদের পাতা, শিকড়, বাকল দিয়ে স্বামী নিজে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন এবং অন্যের কাছে গাছের চারা, ফল, বাকল ও পাতা, বিক্রি করেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে আয় হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। মোটামুটিভাবে পুরো সংসারই এখন ভেষজ উদ্ভিদের আয়ের উপর নির্ভরশীল।

২০১৪ সালে বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস থেকে পরামর্শ নিয়ে বাড়ি সংলগ্ন ১০ কাঠা জমিতে ৮৫টি কুলের চারা রোপণ করেন নীপা। তারাই বলা চলে বটিয়াঘাটা উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষের উদ্যোক্তা। দিনে দিনে সংসারে উন্নতি হতে থাকে।

বসবাসের কাঁচা ঘরের জায়গায় গড়ে তুলেছেন একতলা পাকা বাড়ি। এখন স্বপ্ন একটাই, দুই মেয়ে আঁখি ও মীম বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ ও কৃষি বিজ্ঞানের উপর  উচ্চতর ডিগ্রী নেবে।

নীপার ইচ্ছা কাতিয়ানাংলাসহ বটিয়াঘাটা উপজেলার সকল গ্রামে কৃষকদের পরিবেশসম্মতভাবে সবজি, ভেষজ উদ্ভিদ, ধান ও মাছ চাষে সহযোগিতাসহ দরিদ্র জনগণের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়নে তাদের পাশে থেকে কাজ করার। কারণ তিনি জানেন, তাদের এ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় গ্রামীণ কৃষকদের জীবন-জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনুসরিত হতে পারে।

শেয়ার করুন: