অবসান হোক বঞ্চনার, উন্মুক্ত হোক সমতা

Women in Landসানজিদা খান রিপা: রাহেলা বানু (ছদ্ম নাম) বয়স ৫০ এর কোঠায়। স্বামী বিদেশ থাকেন প্রায় ১৫/১৬ বছর হলো। রাহেলার বাবা মারা যাওয়ার আগেই সব সম্পত্তি তার এক ছেলে ও এক মেয়ের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন। তাই গ্রামে ভাইয়ের সম্পত্তি, নিজের সম্পত্তি, সংসার, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বিয়েশাদি, আত্মীয়-পরিজন এবং স্বামীর সম্পত্তি ইত্যাদি রাহেলা একাই দেখাশোনা করেন। সবকিছু মিলিয়ে পরিবারে রাহেলা বানুর একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি হয়েছে। সবাই তাকে সমীহ করে চলে, তার যে কোনো সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এমনকি ছেলে এবং মেয়ের শ্বশুরবাড়ীর লোকজনও রাহেলা বানুকে বেশ সমীহ করেন।

(২)

হাসি বেগম বয়স ৩৫। এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে তার। হাসির স্বামী সফিউল্লাহ বিদেশ থাকেন সাত বছর হলো। গ্রামে শ্বশুরের ভিটেতেই সংসার তার। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারের প্রয়োজনীয় হাট-বাজার থেকে শুরু করে সন্তানদের লেখাপড়া, কৃষিজমি ইত্যাদি সব কাজ তিনি একাই দেখাশোনা করেন। কিছু জমি তিনি বছরে পত্তনি দেন আর কিছু জমিতে ধান, ভুট্টা ও অন্যান্য ফসলের আবাদ করেন। উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রির কাজও তিনি নিজেই করেন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম দিয়ে স্বামীর সংসার খুশি মনেই আগলে রাখেন হাসি। কিন্তু হাসির মুখের হাসি ধরে রাখতে পারেনি হাসির স্বামী। এত পরিশ্রমের পরও পরিবারে হাসির মূল্যায়ন নেই, সংসারে নেই হাসির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। শারীরিক শ্রম দিলেও সংসারের সকল সিদ্ধান্ত টেলিফোনের মাধ্যমেই জানান তার স্বামী। হাসি পৈতৃকি সম্পত্তির অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত, তেমনি স্বামীর সংসারেও তার নেই কোনো ভূমি মালিকানা।

(৩)

দুটো ভিন্ন, কিন্তু প্রায় একই চিত্র বলে দেয় ভূমি যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নেরই উৎস তা নয় বরং সামাজিক সম্মান ও ক্ষমতার নির্দেশক। ভুমিতে সীমিত প্রবেশাধিকার ও অপর্যাপ্ত ক্রয়ক্ষমতা নারীকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পুরুষের অধস্তন করে রেখেছে, অথচ সার্বিক অর্থনৈতিক বিবেচনায় পরিবারের মোট আয়ের দাবিদার হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি নারীও সমান দাবিদার। গ্রামীণ নারী ও শহরের নারীদের সাংসারিক পরিশ্রমকে যদি আমরা আর্থিক হিসাবে যোগবিয়োগ করি তবে উল্লেখিত দাবি মোটেই অগ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি নারীরা তাদের উপার্জিত অর্থ সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা তথা তাদের ভবিষ্যতের জন্য ব্যয় করে। আবার খাদ্য উৎপাদন, বীজ ও শস্য সংরক্ষণ, পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানে নারীই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

অথচ এই নারীর ভূমি অধিকারের প্রশ্নে খড়গ হাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রচলিত আইন, সামাজিক বিভিন্ন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুরুষদের সদিচ্ছার অভাব। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীর ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানে বড় বাঁধা হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি ভূমিতে নারীর প্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণাধীকার নির্ধারিত হচ্ছে পরিবারের পুরুষ সদস্যের সাথে নারীর সম্পর্কের ভিত্তিতে। এ সমস্ত প্রতিবন্ধকতা নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথ কে সংকুচিত করছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দারিদ্রমোচনে প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

নারীরা ‘অধিকার’ সম্পর্কে অসচেতন এবং ‘আইন’ সঠিকভাবে বোধোগম্য না হওয়ার কারণে যেমন তাদের সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে জানতে পারছে না বা সেভাবে দাবি করতে পারছে না পরিবারের সদস্যদের কাছে, আবার বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ দাবি তুললেও পরিবারের পুরুষ সদস্যরা এর বিরুদ্ধাচারণ করে। অনেকক্ষেত্রে নারী নিজেই তার পিতার সম্পত্তির অংশ ভাইদের কাছে দাবি করেন না, কারণ এতে করে পরবর্তীতে ভাইদের সাথে তার পারিবারিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে।

অন্যদিকে, সরকারের খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন নীতিমালায় স্বামী-স্ত্রীর যৌথ মালিকানার বিধান থাকলেও নানাক্ষেত্রে তা নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। এ নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে একজন বিধবা নারীর যদি প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রসন্তান থাকে কেবল তখনই সে খাসজমি প্রাপ্তির আবেদন করতে পারে। যে বিধবা নারীর শুধু কন্যাসন্তানই আছে, কোনো পুত্রসন্তান নেই- নীতিমালায় উল্লিখিত অগ্রাধিকার তালিকায় এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।

বিশ্বায়নের প্রভাবে এবং কর্মসংস্থানের আশায় গ্রামগঞ্জে বা শহরে পুরুষদের বিদেশমুখীতার ফলে নারী-প্রধান পরিবারের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, পুরুষরা পরিবারের দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন নারীর কাছে। নারী পরম মমতায় আগলে রাখেন তার ক্ষেত-খামার, জমি-জমা। এছাড়াও, নারীরা ঘর সংসারের কাজ সামলিয়ে পুরুষের পাশাপাশি ক্ষেতে খামারে রোদে পুড়ে ঘাম ঝড়িয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করছে।

নারী কৃষকদের এ শ্রমের ফলে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের সার্বিক অর্থনীতি। অথচ, রাষ্ট্র এই নারীদের কৃষক হিসেবে তার পেশার স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ফলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেয়া কৃষি ঋণ, প্রযুক্তি সহায়তা, সার, বীজ, কিটনাশক ও অন্যান্য সেবা প্রাপ্তি থেকে নারী কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি কৃষি বাজারে তার প্রবেশাধিকার না থাকায় সঠিক বাজারমূল্য থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই দারিদ্র্যের মাপকাঠিতে নারীর অবস্থান পুরুষের অনেক নিচে। উপরন্তু  সমাজে খুন, ধর্ষণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুক, তালাক এমনকি ভূমি থেকে উচ্ছেদের মতো সহিংসতার বলিও হচ্ছে নারীরা। অনেক ক্ষেত্রেই এ সকল সহিংসতা ভূমি সংক্রান্ত বিবাদেরই ফল। নারীর প্রতি এ সকল সহিংসতারোধে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় নারী প্রতিনিয়ত ভূমিতে প্রবেশাধিকার হারাচ্ছে এবং সবচেয়ে বড় কথা তাদের স্বাভাবিক ও নিরাপদ জীবন যাপন ব্যহত হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত দরিদ্র নারীরাও তাদের ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যাদের হাত ধরে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা এদেশে আসছে সেই নারীরাই আবার পিষ্ট হয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে এর ছাদের নিচে চাপা পড়ে, কিংবা অনেক সময় আগুনে পুড়ে।

কর্মসংস্থানের আশায় গ্রাম থেকে দলে দলে আসা এসব ভূমিহীন দরিদ্র নারীদের হাতগুলোকে সুঁইয়ের ফোঁড়ে ক্ষত বিক্ষত না করে সরকারি খাসজমি ভূমিগ্রাসীদের কবল থেকে উদ্ধার করে তাদের নামে বণ্টন করে নারী কৃষকের মর্যাদা ও অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দেশের কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালি করা জরুরী। এতে করে তারা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। অন্যদিকে কৃষিজমির সুরক্ষা করাও সম্ভব হবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

সানজিদা খান রিপা, উন্নয়নকর্মী ([email protected])

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.