তানিয়া মোর্শেদ: এপ্রিল ৪, ২০১৩। এক ব্লগারের পোস্টে পড়লাম, কেন, কিভাবে গ্রামের দরিদ্র শিশুরা মাদ্রাসায় যায়। যা আমার অজানা কিছু নয়। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে অসংখ্য দেশে মানুষের দরিদ্রতা আর অশিক্ষাকে পুঁজি করে চলছে এই ধর্ম ব্যবসা, অনেক অনেক বৎসর ধরে।
১৯৭১-এ গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত মানুষেরা না থাকলে স্বাধীনতা আসতো না, তাঁদের ত্যাগ অপরিসীম, বেশীর ভাগ মুক্তিযোদ্ধার শেকড় গ্রামে। তাঁদের কাছ থেকে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” যেদিন থেকে শুধুই শহুরে বুদ্ধিজীবীদের দখলে চলে যায় সেদিন থেকেই রাজাকার, জামাত, শিবিরের পুনরুত্থান! অথচ স্বাধীনতার পর আরও বেশী করে গ্রামের মানুষকে বোঝানো দরকার ছিল, স্বাধীনতা কি করে ধরে রাখতে হয়। যে দেশের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি মানুষের বাস গ্রামে, সেদেশে উন্নয়ন থেকে শুরু করে যে কোনও চেতনাই শুধুমাত্র শহরমুখী হলে চলে?!
আজ বাংলাদেশের অনেকের মুখে, “দেশ আজ কোথায়, কি নেই বাংলাদেশে” ইত্যাদি এত গর্বভরে উচ্চারণ শুনি! কখনো সরবে, কখনো নীরবে বলি, কাদের রক্তঝরা শ্রমের বিনিময়ে? পোশাক শিল্প আর বিদেশে শ্রমিকদের উপার্জনের মাধ্যমেই তো! এ তো রক্তঝরা শ্রম! আরা এরা কারা জানেন তো!?
এপ্রিল ৬, ২০১৩
টিভিতে পিল পিল করে আসা লং মার্চের হেফাজতি মোল্লাদের দেখে আমি পেট চেপে ধরে বলা শুরু করলাম যে আমার অনেক ব্যথা হচ্ছে … অনেক ব্যথা! এ কাজ আমি কখনোই করিনি। না প্রথমবার বায়েপ্সি রেজাল্ট জানবার পর … না দ্বিতীয়বার …না তৃতীয়বার! আতংকে, ঘৃণায়, দুঃখে, হতাশায়, লজ্জায় বলতে লাগলাম যে, আমি এই দেশে জন্মেছি? এই দেশে? এই দেশের মানুষের জন্য আমার প্রাণ সব সময় কাঁদে? এই দেশের মানুষের খবর আমি আইসিইউ’তে থেকে জিজ্ঞেস করেছি?
অসুস্থ বাবা, চিন্তিত মা কেমন আছেন জানতে চাইনি! হাত সামান্য নাড়াবার মত হতেই এই দেশের মানুষের জন্য কাজ শুরু করেছি আবার? (এখন পর্যন্ত আমি আমার সন্তানের জন্য কয়েকদিন ডিম সেদ্ধ আর একবার অতি সহজে রান্না করা যায়, রান্না না বলাই ভালো, সুপ বানিয়েছি)।
যাদের জন্য কিছু করবার চেষ্টা করছি, তাদের মধ্যে কেউ এই মিছিলে শামিল (ভবিষ্যতে) হবে না এমন নিশ্চয়তা কে দেবে! আমি আর কাউকে বিশ্বাস করবো কিভাবে? কেন?
আমি একবার বললাম যে, একাত্তরে কি এত পাকিস্তানী সেনা এসেছিল? আমার পায়ে সার্জারী এবং ক্যান্সার জানবার পর মাঝে মাঝে আমার মনে হতো ক্যান্সার আমার পা থেকে উঠে আসছে উপরের দিকে, শিউরে উঠতাম! সত্যি ক্যান্সার সেল আমার পা থেকে লাংসে বাসা বেঁধেছে (ছিল কি বলতে পারবো!) আমার আরেক দুঃস্বপ্ন শুরু হলো!! আমি দেখতে থাকবো কি মোল্লারা উঠে আসছে … উঠে আসছে … আমার প্রিয় জন্মভূমিকে … না আমি আর ভাবতে চাই না! ছোট্টবেলায় আমার ছেলে দীপ্ত একবার জিজ্ঞেস করেছিল যে, আমি ও’কে বেশী ভালবাসি না বাংলাদেশকে? কয়েক সেকেন্ড পর বলেছিল যে, আমি যদি বলি বাংলাদেশ, তাহলে ওর কোনও অসুবিধা নেই! ছোট্টবেলায়ই সে বুঝে গেছে যে, তার মা’র কাছে বাংলাদেশ কী! আমি আর কোনও দুঃস্বপ্ন দেখতে চাই না! যদি এই দুঃস্বপ্নই দেখতে হবে তবে একাত্তরেই পাকিস্তানী সেনাদের হাতে মারা যাইনি কেন?
উপরের লেখাটুকু আমার “এক যোদ্ধার ডায়েরী” বই থেকে। নতুন কিছু লিখবার দরকার আছে কি? এই দু’ বৎসরে অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর হয়েছে। একদিকে মুক্তমনারা খুন হয়ে চলেছেন, আরেক দিকে মডারেট মুসলমানরা এখনো নিশ্চুপ। আরেকদিকে তথাকথিত প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, মানবতাবাদী নিজেদের ইত্যাদি ভাবা কিছু মানুষ এখনো মাদ্রাসা শিক্ষাকে জায়েজ করে চলেছেন!
ধর্মকে যতদিন রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা যাবে না, শিক্ষাকে ধর্মমুক্ত করা যাবে না, ধর্ম/অধর্ম যে অন্তরে লালনের বিষয়, পরিধানের নয়, এটা সমাজে যতদিন প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন আমার জন্মভূমিকে অন্ধকারের দিকেই নিয়ে যাবে!