
ফারহানা আনন্দময়ী: দিনটা ১৩ই মার্চ, গোধূলিতে পেয়েছিলাম কিছু টাটকা রোদ্দুর। সেই রোদ্দুর আলো ছড়াচ্ছিল জোরালো, পশ্চিম আকাশের ঢলে যাওয়া সূর্য থেকে কিন্তু নয়… একজন নাগরিক কবিয়ালের কণ্ঠ থেকে। কলামন্দিরে সেদিন ছিল শিল্পী কবীর সুমনের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানের এক অনুষ্ঠান, ‘মুক্ত হাওয়ার বসন্তে’। আমার জীবনে এই-ই প্রথম কবীর সুমনের গান মঞ্চে মুখোমুখি বসে শোনা। স্বীকার করতেই হবে, এ আমার এক অনুপম অভিজ্ঞতা। তীব্র সাধ থাকা সত্বেও এর আগে কাঁটাতার পেরিয়ে গিয়ে তাঁর অনুষ্ঠান শোনার এবং দেখার সুযোগ ক’রে উঠতে পারিনি।
তিনি একবার ’৯৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন বটে গান গাইবার জন্যে। মনে পড়ে, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ক্যাম্পাস এলাকার বাইরে খুব বেশি যাতায়াত ছিল না আর সেই অনুষ্ঠানের প্রচার সেরকম ছিল না তাই জেনেছিলামও একেবারে শেষ মুহূর্তে। প্রভাবশালী কারো সঙ্গে যোগাযোগের পরিধি খুব সীমিত ছিল। তাই আমার সাধ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করা সত্বেও সেই অনুষ্ঠানের একটা প্রবেশপত্র জোগাড় করতে পারিনি। সেদিন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাওয়ার পরেও ব্যর্থ আমি, বিষণ্ন আমি ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের মূল ফটকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, যদি কোনোভাবে, কাউকে বলে একবার প্রবেশ করা যায়। পারিনি, সেই আক্ষেপ আমি বয়ে বেরিয়েছি ১৯ টা বছর।
’৯৬ থেকে ২০১৫…এতোদিন পরে এসে সুযোগ হলো মঞ্চে ব’সে কবীর সুমনের গান শোনার। শুধু শোনাই বা বলি কী ক’রে ? এতো দেখারও। প্রতিটি গানের সঙ্গে তাঁর অভিব্যক্তির পরিবর্তন… সেও এক দেখার বিষয় বৈকি। অনুষ্ঠানটা দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, মহাকাল স্থির হয়ে যাক, ঘড়ির কাঁটা থেমে যাক… তারা কি আর থামে আমার ইচ্ছের অনুরোধে? তাই শেষের বেলায় নিজেকেই গুনগুনাতে হলো… ‘আর কী কখনও কবে, এমনও সন্ধ্যা হবে…।’
’৯৩ এর প্রথমদিকে প্রথম শুনেছিলাম, ‘ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই…’ সেই আমার ডানা মেলা শুরু সুমনের গানের সুরে। তাঁর গানেই মন আর কান, দুটো দিয়েই স্পর্শ করতে চেয়েছি আধুনিক বাংলা গানের পরম্পরা। সকলে বলতো তিনি জীবনমুখী গান বাঁধেন, আমার মনে হতো এ হলো সময়ের গান, আমার সময়কে ধারণ করে যে বোধ, সেই বোধের গান।
রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান’ এই গানটা যেমন আমার প্রতি ভোরের প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে মনে গেঁথে নিয়েছি, ঠিক একইভাবে কবীর সুমনের গানের সঙ্গে পরিচয়ের পরে তাঁর গানের ‘আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু…’ এই লাইনটিও আমার জীবনবোধের দেয়ালে শক্ত পেরেক ঠুকে বাধিয়ে রেখেছিলাম। ভীষণ মান্য করে চলি আমি সেই বোধ, আজ অবধি একইরকম বিশ্বাসে। এর আগে পিছে মাঝখানে তাঁর কত শত গান আমাকে মুগ্ধ করেছে, মুগ্ধ ক’রে রেখেছে সেই হিসেব আমি রাখিনি, হিসেবের খাতায় জায়গা ধরবে না, তাই হয়তো রাখিনি।
এতো গেল বাংলা আধুনিক গান, কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের পরে যে মানুষটার গাওয়া রবীন্দ্রগান এক অন্য মাত্রার ব্যঞ্জনা তৈরী করেছে আমার কানে, প্রাণে… তিনি কবীর সুমন। এবং কলামন্দিরে সেই সন্ধ্যায় তিনি শুধু রবীন্দ্রগানেই পুরো সময়টা অর্থাৎ পুরো দুইটা ঘন্টা আমাকে সম্মোহিত করে রাখলেন। আবারও বলবো এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
ঘড়ি ধরে ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায় তিনি গাইতে শুরু করলেন। ‘দিয়ে গেনু বসন্তেরও এই গানখানি…’ গানটা দিয়েই তিনি বসন্তের মুক্ত হাওয়া আসার জানালা খুলে দিলেন। এরপর একে একে গাইতে থাকলেন বসন্তেরই গান… কখন যে ঋতু বদল হলো, সময় বদল হলো টেরই পেলাম না। প্রেম , পুজা, প্রার্থনা, প্রকৃতি সব মিলেমিশে একাকার। আসলে সত্যিকার অর্থে রবীন্দ্রনাথের সকল গানই তো মূলতঃ প্রেমের গান। প্রকৃতি প্রেম তাই কখন যে মানবপ্রেম হয়ে মূর্ত হলো তাঁর কণ্ঠে, আলাদা করতে পারিনি। তবে এটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি রবীন্দ্রনাথের মত অসীম এক আকাশকে তিনি কোথায় ধারণ করেছেন, কতটুকু ধারণ করেছেন আর কতদূর পর্যন্তই বা ধারণ করেছেন। গান, গানের ফাঁকে তাঁর কথা, তাঁর ব্যথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুধুই আত্মস্থ করেছি, ধ্যানস্থ হয়েছি আবার ধ্যান ভেঙে বৈষয়িক মানুষের মত গোপন সিন্দুকে জমিয়ে রেখেছি সেই ঐশ্বর্য-স্মৃতি। গানের ফাঁকে তাঁর কথা শুনতে শুনতে কখনো এমনও মনে হয়েছে, তিনি যদি গান না গেয়ে শুধুই কথা বলে যান তাও বোধহয় আমি ক্লান্তিবিহীন অন্তবিহীন সময় ধ’রে শুনে যেতে পারবো।
এ তো শুধু গান নয়, কথা নয়, এ এক জীবনপাঠ। সেই পাঠে তাঁর জীবনের কথা, হয়ে ওঠা গানের কথা, কোন পথে গান গেল সেই কথা, তাঁর অপমানের কথা, তাঁর অভিমানের কথা… যে কথা শুধু তাঁরই রইলো না, আমারও হয়ে গেল আমারই অজান্তে। আবার একসময় গানটাও কেমন ক’রে যেন মঞ্চ থেকে দর্শক সারিতে চলে এলো, তিনি কলামন্দিরের মিলনায়তন ভরা দর্শককে দিয়ে গাইয়ে নিলেন ‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা…।‘ কখনো নারী-পুরুষ মিলিত কণ্ঠে, আবার কখনো নারী-পুরুষ ভাগ ক’রে গাইলাম দু’লাইন ক’রে। আহা! যেন সুরের ঝরণাধারা বয়ে গেল পুরো মিলনায়তন জুড়ে। এরপর গান আবার ফিরে গেল মঞ্চে। তিনি অবশ্য আমাদের জন্যে গানের দ্বার অবারিত রেখেছিলেন, তাঁর প্রত্যেকটা গানের সঙ্গে নিজের মত ক’রে আমাদের গলা মেলানোর জন্যে। তবে আমাদের মনে হয়েছে তাঁর সঙ্গে গলা মেলানোর চেয়ে তাঁর গানে বুঁদ হয়ে থাকাটা অধিকতর আনন্দের।
তিনি মঞ্চে একা, কোনো সহযোগী বাদ্যযন্ত্রী নেই… একাই কিবোর্ড বাজিয়ে প্রায় ৩০টা রবীন্দ্রনাথের গান গাইলেন। বন্ধু যারা নিয়মিত তাঁর অনুষ্ঠান দেখেন, তাঁদের কাছে জেনেছি, তাঁর গানের সুসময়ে তিনি মঞ্চে একাই একাধিক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গানে মাতিয়েছেন। অর্থাৎ মঞ্চের এধার থেকে ওধার জায়গা বদল ক’রে মঞ্চে স্থাপিত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিজে বাজিয়ে গান গেয়েছেন। আমার সেই সৌভাগ্য হলো না দেখার কিংবা শোনার। যেটা দেখেছি সেটাতেই ফিরি, বিস্মিত হয়েছি, তিনি আজ ৬৬ বছরে পৌঁছেছেন, এই বয়সে তাঁর স্মৃতিশক্তির ধার দেখে। এতোগুলো গান গাইলেন, অথচ সামনে তাঁর কোন গীতবিতান বা গানের খাতা নেই। কী অনায়াসে গেয়ে চলেছেন মনের খাতা দেখে দেখে, অবাক হতেই হয়।
এভাবে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে বেশিপ্রিয়, কমপ্রিয়, বহুশ্রুত, কমশ্রুত কত রবীন্দ্রগান তিনি শুনিয়ে গেলেন, প্রাণে বসন্তের বাতাস বইয়ে দিলেন। আরো যেটা করলেন, অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় তিনি মিলনায়তনের আলো না নেভাতে অনুরোধ করলেন। তিনি দর্শকের সঙ্গে আলো-বাতাসে ভাবের হাত-পা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বোধকরি। সেও এক নতুন অভিজ্ঞতা, নয় কি ?
তাঁর গান ছাড়াও আমার কাছে যেটা উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে তা হলো, নিজের অনুভূতি প্রকাশে ভীষণ অকপট, দারুণ স্পষ্ট তিনি। মঞ্চে ব’সে খুব কম শিল্পীই পারবেন শক্ত উচ্চারণে দর্শকের অভব্যতার প্রতি আঙুল নির্দেশ করতে। একবার হলো কী, শুরুর দিকে, তিনি প্রায় ৫/৬টা গান গেয়েছেন… তখন সময়ের অনেক পরে কিছু দর্শক মিলনায়তনে ঢুকে আসন খোঁজার জন্য তোড়জোড় করছেন। কবীর সুমন গান থামিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন, দেখলেন সেই দর্শকেরা এদিক-ওদিক হাঁটছেন। এবার তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাদের কোন অধিকার নেই এভাবে রবীন্দ্রনাথকে অসম্মান করার, এবং একই সঙ্গে তাঁর গান আর আমাকেও।
কবীর সুমন মঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন। যেতে যেতে বলে গেলেন, আপনারা শান্ত হয়ে বসার পরে আমাকে ডাকবেন গান শোনাবার জন্য, আমি তখন ফিরবো মঞ্চে। পারবেন না, আমার মনে হয় এই সময়ের অনেক বড় তারকা শিল্পীও এই দৃপ্ত সাহস মঞ্চে দেখাতে পারবেন না, নত হতেই হয় তাঁর ঋজুতার সামনে।
এভাবে গানে , কথায়, আড্ডায়, হাসিতে, কান্নায় কেটে গেল আড়াইটা ঘন্টা, শেষ টানলেন তিনি ‘আজি যে রজনী যায়…’ গানটি গেয়ে। সেই অসাধারণ সন্ধ্যাটি রাতে গড়িয়ে পড়লো, ঘড়ির কাঁটা তার ইচ্ছেতেই চললো, থামলো না কোথাও একবারের জন্যেও। জীবনের সঞ্চয়ের পাত্র কবীর সুমনের কণ্ঠের মাধুরীতে উছলে পড়লো, রেশ রইলো দীর্ঘক্ষণ। এতো অসামান্য প্রাপ্তির মধ্যে না-পাওয়ার রঙ একটুখানি, অনেকদিনের সাধ ছিল, ‘তোমায় গান শোনাবো…’ তাঁর কণ্ঠে শুনবার। এবারের যাত্রায় শোনা হলো না, আশায় বাঁচি, শোনা হবে অন্য কোন গানের ভোরে।
আর শেষের আগে যে কথাটি না বললেই নয়, এই অনন্য অনুষ্ঠানটা দেখার সুযোগ হতো না, ঋজু তাঁর বন্ধুতার হাতটা বাড়িয়ে না থাকলে। ধন্যবাদ ঋজু, কৃতজ্ঞতা উর্মিমালা’দির প্রতিও। অনুষ্ঠান শেষে তিনিই সঙ্গে ক’রে নিয়ে গেলেন গ্রীনরুমে… যেখানে যায় না কোন নেয়ে সাহস ক’রে, দেখা হলো কাছ থেকে, কথা হলো প্রিয় শিল্পীর সঙ্গে, জানালাম সুদূর চট্টগ্রাম থেকে এসেছি গানের টানে।
তাঁর দিকে তাকিয়ে মুখে বলতে পারিনি, তবে মনে মনে ঠিক শুনিয়ে এসেছিলাম তাঁকে, গান দিয়ে দ্বার খোলানো তেজস্বী কণ্ঠের সেই মানুষটাকে…
“তরুণ হাসির আড়ালে কোন্ আগুন ঢাকা রয়…
এ কী গো বিস্ময়।
অস্ত্র তোমার তোমার গোপন রাখো কোন্ তুণে… দেখা পেলেম ফাল্গুনে।“
পাদটীকাঃ আমার সবিনয় অনুরোধ এই লেখাটা পড়ে বন্ধুরা কেউ রাজনীতিক কবীর সুমনের সঙ্গে গানওয়ালা কবীর সুমনকে মিলিয়ে ফেলবেন না।