অবশেষে মুক্ত বাতাসে জান্নাতি

Jannati 3উইমেন চ্যাপ্টার: অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আট মাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন উদ্যোক্তা জান্নাতি হোসেন। একটা বিশাল জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল বুকের ভেতরে, তার মুক্তির মধ্য দিয়ে তা নেমে গেল। কিন্তু এই নামার প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল ছিল। অনেক জানান দিয়ে গেছে রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে। জান্নাতির মাকে বিশেষ অভিবাদন নিজেকে শেষপর্যন্ত ধরে রাখার জন্য, কোন ভয়-হুমকির কাছে নতজানু না হওয়ার জন্য।

এই একটা মামলার মধ্য দিয়েই উঠে এসেছে এই দেশের আইনব্যবস্থার ফাঁকফোকরগুলো। ক্ষমতা আর প্রভাব যে আইনকে কিভাবে প্রভাবিত করে, তা এক জান্নাতির মামলা দেখেই উপলব্ধি হয়। এটাও বুঝতে বাকি থাকে না, এরকম কত জান্নাতি আজ কারাগারে পড়ে আছে শুধুমাত্র প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণে। এই দেশ কবে হবে সেই দেশ যখন ন্যুনতম মানবাধিকার নিয়ে মানুষ বাঁচবে এখানে।

জান্নাতির কিছু বিশেষ বন্ধুদের কল্যাণে আমরা জানি, সড়ক দুর্ঘটনায় সহযাত্রী ও ব্যবসায়িক অংশীদারের মৃত্যুর পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। ২০১৪ সালের ১১ জুলাই মধ্যরাতের ঘটনা ছিল এটি। রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর গেটের দিকে যাওয়ার সময় শাহীনবাগ এলাকায় একটি প্রাইভেটকার পুলিশের একটি পিকআপকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে কারটি দুমড়ে মুচড়ে যায় এবং নিহত হন এর আরোহী কে এম মোস্তামসি আশরাফ শুভ্র। গাড়িটি তখন চালাচ্ছিলেন তারই বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার অটোমোবাইল ম্যাগাজিন ‘টর্ক’ এর সম্পাদক ও তরুণ উদ্যোক্তা জান্নাতি হোসেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে তেজগাঁও থানার এসআই সর্দার নিজামুল হক পরদিন জান্নাতির বিরুদ্ধে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে মামলা করেন।

দশ দিন পর নিহত শুভ্রর চাচা আবদুল হান্নান খান ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে জান্নাতির বাবা, মা ও দুই ভাইকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। এরপর আদালতের আদেশে দুই মামলা একীভূত করে একটি মামলা হিসেবে তদন্ত শুরু হয়। মুক্তি পাওয়ার আগে জান্নাতিকে হাইকোর্টের চারটি বেঞ্চ ঘুরে জামিন পেতে হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি রুলের চূড়ান্ত শুনানি করে বিচারপতি মো. নিজামুল হক ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বেঞ্চ তাকে স্থায়ী জামিন দেন। এক সপ্তাহ পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন জান্নাতি।

এর আগে নিম্ন আদালতে জামিন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে হাইকোর্টে আসেন জান্নাতির আইনজীবীরা। হাইকোর্টের দুই বেঞ্চ ওই আবেদনের শুনানি করে তাদের ফিরিয়ে দেন। পরে এক বেঞ্চ শুনানি করে রুল দিলেও রুল শুনানির সময় ওই বেঞ্চের এক বিচারক বিব্রত বোধ করেন। সোমবার রাষ্ট্রপক্ষের করা জামিন স্থগিতের আবেদনে চেম্বার জজ বিচারপতি মো. ইমান আলী ‘নো অর্ডার’ দেন।

আদালতে জান্নাতির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী বাসেত মজুমদার, সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাসুদ হাসান চৌধুরী পরাগ।

জান্নাতির এই মামলাটি পরিচালনা করতে গিয়ে বার বার হতাশ হয়েছেন তার বন্ধুরা, এমনকি আইনজীবীরাও।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এক পর্যায়ে লিখেন, ‘মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে জান্নাতির জামিন লাভ এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক সেই আদেশ বহাল রাখার পরও ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদেশে আজ জান্নাতির জামিননামা দাখিল করা সত্ত্বেও সেটি প্রসেস করা যায়নি। খোদ মুখ্য মহানগর হাকিমকে না জানিয়ে যেন কেউ জামিননামা দাখিল করতে না পারে সেই মর্মে সবখানে মৌখিক নির্দেশনা ছিল বিধায় জান্নাতিকে আরও একদিন জেলে থাকতে হচ্ছে। এটি মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আদালত অবমাননা। ক্ষমতা থাকলে এদেশে সব কিছু করা যায়। আমরা চুনোপুঁটিরা কেবল দেখে যাব’।

বৃহস্পতিবার জামিনের দিন ধার্য থাকলেও সকাল থেকে নানারকম তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় আদালতে। আবারও মি. বড়ুয়া লিখেন, মুখ্য মহানগর হাকিম আজ জান্নাতির মূল পাসপোর্ট দাখিলের শর্ত আরোপ করেন। তারা এটা ভাল করেই জানেন যে, জান্নাতির পাসপোর্টের মেয়াদ তিন বছর আগেই শেষ হয়েছে। তারা সিএমএম এর সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে হাকিম বলেন, অবরোধ এবং হরতালের মধ্যে তিনি দেখা করবেন না। নতুন করে আবেদন পত্র জমা দিতে যাচ্ছি, তবে এটাও প্রত্যাখ্যাত হতে যাচ্ছে বলেই নিশ্চিত। কাজেই ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননাই এখন একমাত্র উপায়। সম্ভবত জান্নাতি শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছেন না’।

জান্নাতির এই কেসটির গতি-প্রকৃতি যেভাবে প্রভাবশালীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে, যেভাবে জান্নাতিকে দিনের পর দিন কারাবাস করতে বাধ্য করা হয়েছে মামলাটি জামিনযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও, সেখানে এই দেশের আইনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারা এই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষ? কাদের কাছে আইন মাথানত করে থাকে? কেন সাধারণ মানুষ আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়? তাদের জন্য বলা যে, এই কেসটি নি:সন্দেহে আইনের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য একদিন কাজে আসবে ।তারা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন এই মামলাটি।

জান্নাতির বন্ধু তাসলিমা মিজি লিখেছেন, যারা আইনকে (অপ)ব্যবহার করে মানুষের জীবন ধ্বংস করতে চায় তাদেরও কাজে লাগবে। আইনের হেন কোন ফাঁকফোকর নেই যা এ মামলায় শুভ্রর পরিবার জান্নাতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেনি। সোজা ভাষায় বলেই ফেলি: আজ মেয়েটি বের হতে পারেনি কারাগারের অন্ধকার থেকে। সিএমএম কোর্ট এ গিয়ে দেখি সিএমএম(চিফ মেট্রো ম্যাজিস্ট্রেট) নেই। সব অফিসিয়ালদের বলে রেখেছেন জান্নাতির কেসের পেপার আসলে বেইল বন্ড প্রসেস করা যাবেনা। একটু অনুরোধ আর তদবির করার চেষ্টা করলে তারা বলেন, মাফ চাই, এটা টাকা পয়সার ব্যাপার না, আমরা কিছু করলে আমাদের চাকুরী চলে যাবে। আপনারা কাল আসেন। এরপরও আমরা কিছু সময় বৃথাই অপচয় করে চলে এসেছি। ওকে স্বাগত জানানোর জন্য কিনে রাখা ফুলগুলো বাসি হবে। কাল আবার যাবো। হবেই হবে। হতেই হবে। ওরা জান্নাতির জীবন থেকে আরো কিছু ঘন্টা নিয়ে নিল আর কি!!!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.