সুমন্দভাষিণী: শান্তিবাগ একটি ছোট্ট মফস্বল শহরের ছোট এক পাড়ার নাম। সেখানে শান্তি কতখানি আছে তা জানা নেই। তবে মানুষ আছে গিজ গিজ। ঘরে ঘরে মানুষ, ছোট থেকে বড়, মাঝারি থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী। সব ধরনের চাকরিজীবী মানুষেরই বাস এই শান্তিবাগে। আমাদের ছোটবেলায় অতবেশি ঘর ছিল না। প্রাথমিক স্কুলের পিছনের এই দিকটায় ছাড়া ছাড়া কতগুলো বাঁশের বেড়ার ঘর ছিল। সেই ঘরে যারা ছিল, তারাও একে-অন্যের পরিচিত ছিল।
তখন শান্তিবাগে মোটামুটি শান্তি ছিল। সকালবেলা ঘরগুলোর পুরুষেরা চাকরিতে চলে যেত, বেশিরভাগই করতেন সরকারি চাকরি। নারী আর শিশুরা থাকতো বাড়িতে। স্কুলগামী ছেলেমেয়েগুলো হাতে বইয়ের বোঝা নিয়ে কেউ স্কুলে যেত, কেউ বা স্কুলে যাওয়ার নাম করে অন্য পাড়ার মেয়েদের বাসার সামনে বাঁদরামো করতো। তবে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির পুরুষেরা ফিরে এলে ঘরভর্তি বাচ্চাকাচ্চার পড়াশোনার শব্দ উপচে পড়তো। পুরুষরা ভাবতো, আহা, আমার ছেলেটা! হয়তো বাড়ির কর্ত্রীকে ডেকে এক গ্লাস দুধও দিতে বলতেন ছেলেকে। সারাদিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করা কর্ত্রীরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছেলের টেবিলের সামনে বেশ জোর শব্দ করেই গ্লাসটা রেখে চলে যেতেন। যেতে যেতে বিড়বিড় করে মুখপোড়া ছেলেকে বকাঝকা দিতেন। এভাবে দিনের পর দিন গোপন করে যেতেন ছেলেদের সারাদিনের কর্মকাণ্ডগুলো।
কোন ছেলে কোন বাড়ির মেয়ের পিছনে ঘুরে, কার প্রেমপত্র পাওয়া গেল বালিশের তলায়, কে স্কুলে যায় না দিনের পর দিন, কোচিং মাস্টারের কাছেও ফাঁকি, এসব কথা বাড়ির কর্ত্রীরা খুব সযতনে মনের ভিতরে রেখে দিতেন, জানতে দিতেন না ‘খেটে খাওয়া’ পুরুষদের। পুরুষরা তখন বাইরের চক্ষু দিয়ে দেখতেন আর চোয়ালে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ভাবতেন, আমার সোনার সংসার। হয়তো পরদিন আরেকখান শাড়ি আসতো মধ্যবাজারের শাড়ির দোকান থেকে। কর্ত্রী ঠাণ্ডা তো, জগৎ ঠাণ্ডা।
এখন সেই শান্তিবাগে অনেক বাড়ি, সব কেমন যেন লাগা লাগা। একটাও আর কাঁচাপাকা বাড়ি নেই। সব দালান উঠেছে। রাবেয়া খাতুনের এসব দেখে ভালই লাগে। ঈশ্বরগঞ্জ থেকে যখন পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে এই পাড়ায় এসেছিলেন, তখন আশপাশে বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনও পেয়ে গিয়েছিলেন। স্বামী সরকারি কর্মকর্তা, কী যেন বলে, শিক্ষা কর্মকর্তা। কত বড় নাম-ডাক তাঁর। রাবেয়া নিজে পড়াশোনা করেননি। একই গ্রামে শ্বশুরবাড়ি। স্বামীকে জায়গীর রেখে তাঁর বাবা পড়িয়েছিলেন, ছেলেটা মেধাবী ছিল। পরে সেই মেধাবী ছেলেটার সাথেই তাঁর বিয়ে দেন। বিয়ের পর পর প্রথমদিকে স্বামীর সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন চাকরিসূত্রে। যেখানেই গেছেন, সেখানেই আশপাশের বাড়ির নারীদের সাথে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল। নুনটা, ডালটা, তরকারিটার আদান-প্রদান লেগেই থাকতো। উপরওয়ালার কৃপায় রাবেয়ার সংসারে অভাব ছিল না। সবসময় যেন উপচেই পড়তো সব। ছেলের বন্ধুদের একটা বড় অংশ এই বাড়িতেই খেয়ে-পড়ে বড় হয়েছে। রাবেয়া খাতুন নিজে হাতে তাদের খাইয়েছেন।
শোনা কথা, তখনকার রাবেয়া আর এখন যে রাবেয়া চলে গেলেন, তাদের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেই রাবেয়া ছিলেন বেশ স্বাস্থ্যবান, যুবতী এক নারী, কালো হলেও চেহারায় লাবণ্য ছিল। আর এখনকার জীর্ণশীর্ণ রাবেয়া তো সবসময় বড় ছেলেকেই দোষারোপ করতেন তাঁর এই হালের জন্য।
বড় মেয়ের জন্মের পর আরও একটি সন্তান হয়ে যায় রাবেয়া খাতুনের। ছেলে সন্তানের জন্য তিনি তখন মরীয়া। অত:পর জন্ম নেয় ছেলে। গ্রামে-গঞ্জে এসব সন্তানকে বলে ‘মল্লিক’। তাদের কানে ফুটো করে দেয়া হয় কুনজর থেকে বাঁচানোর জন্যে। তো, সেই ছেলের জন্মের সাথে সাথে রাবেয়া কঠিন অসুখে পড়েন। ‘সূতিকা’ রোগে শেষ হয়ে যায় তাঁর স্বাস্থ্য। সেই যে মোটাসোটা রাবেয়ার স্বাস্থ্য ভাঙলো, আর ফিরলো না। এরপর তাদের সংসারে জন্ম নিয়েছে আরও তিনটি সন্তান। দুই মেয়ে আর তিন ছেলের সংসারে বেশ স্বচ্ছলতাই ছিল চিরকাল।
এর মধ্যে সবচেয়ে কাঙ্খিত যেই ছেলে, সেই বড় ছেলেটি যে যন্ত্রণা তাঁকে দিয়েছে, আর কোন সন্তান এতোটা দেয়নি। সব চুপ করে সহ্য করে গেছেন তিনি। কখনও মুখ খোলেননি স্বামীর কাছে। প্রচণ্ড রাগী স্বামী কি করতে কি করে বসবেন, ঠিক নেই, তার চেয়ে ছেলের সুমতি ফিরবে কোনদিন, সেই আশাতেই জীবন পার করে দিলেন রাবেয়া খাতুন।
শান্তিবাগে তাদের বাড়িটি ধীরে ধীরে পাকা দালান হলো। ওই পাড়ায় প্রথম পাকা বাড়ি তাদেরই। একদিকে শিক্ষা কর্মকর্তা স্বামী, বাড়িতে অনেক ধানী জমি, রাবেয়ার বাবার বাড়িও অনেক স্বচ্ছল, অনেক জমির মালিক তাঁরা। এক ভাই ছিল, গ্রামের কোন্দলে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। সেই ভাইয়ের ছেলেমেয়েদেরও তিনি তাঁর কাছে এনে রেখে পড়িয়েছেন। পাশের বাড়ির বৌ-ঝিরা যখনই যার কিছু দরকার পড়তো, রাবেয়া খাতুনের কাছে এসে কাছ-ঘেঁষে দাঁড়াতো। চোখের ঠাহরে রাবেয়া তাদের আড়ালে নিয়ে চালটা-ডালটা দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়েই রাখতেন।
রাবেয়া বলতেন, কাউকে দিলে কখনই শেষ হয় না কিছু। তাঁর উদারহস্ত থেকে কেউ বাদ পড়েনি, ধনী-গরীব, হিন্দু-মুসলিম কেউ না। সবাই তাই তাঁকে ঘিরে থাকতো সবসময়ই। প্রতি শুক্রবারে তাঁর কিছু বাড়তি খানেওয়ালা থাকতো। ফকির-মিসকিনরাও জানতেন এই বাড়ির বেগমের খোলা হাত। তারা শুক্রবার দুপুরের নামাজ শেষেই হাত ধুয়ে এসে বারান্দার একপাশে বসে যেতেন পাত পেড়ে। রাবেয়া ঘোমটা টেনে তাদের সামনে যেতেন, নিজে হাতে তাদের খাবার দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন আর ছোট্ট করে শান্তির নি:শ্বাস ফেলতেন। হয়তো বলতেন মনে মনে, ‘আমার সন্তানরা যেন থাকে দুধে-ভাতে’।
সন্তানে-সন্তানে যাতে রেষারেষি না হয়, সেজন্য রাবেয়াকে কখনও কারও কাছে কারও নালিশ করতে দেখিনি। এ নিয়ে সন্তানদের মধ্যে অভিযোগের অন্ত ছিল না। তারপরও শেষরক্ষা হয়নি রাবেয়ার। কেমন যেন ভালবাসার অভাব বোধ ছিল পুরো সংসার জুড়ে। কিশোরী রাবেয়া যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন, আর আজ যখন যাত্রা করলেন অনন্তকালের পথে, পুরো সময়টা একটা বিশাল লম্বা সফর। এই সফরে তিনি মধ্যজীবনে এসে স্বামীকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেছিলেন। ছেলেরাও কেউ তখনও সংসারের দায়িত্ব নিতে শেখেনি। তিনি নিজে জীবনভর স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সেই অবস্থা থেকে ক্রমে কাটিয়ে উঠলেও, সংসারে আর ভারসাম্য ফেরেনি।
পরবর্তীতে, বড় ছেলে বিদেশে চলে গেলে তিনি এমন কোন ঝাড়ফুক নেই যা করেননি ছেলেকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে। তাবিজ-কবচের জোরেই হোক আর মাতৃত্বের জোরেই হোক, ছেলে তার বিদেশ জীবন ছেড়ে চলে এসেছিল, আর ফেরেনি। কিন্তু এই না-ফেরাটা ছেলের জীবনে কালই হয়ে দাঁড়ায়, অদূরদর্শী ছেলের সংসার ভেঙে যায় খান খান হয়ে। বুকের ধন দুই নাতী আড়াল হয়ে যায় সেই থেকে। তখন থেকে থেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন রাবেয়া খাতুন। কী চেয়েছিলেন, আর কী হলো! এমন করে তো ছেলের সর্বনাশ তিনি চাননি! তবুও ছেলে কাছে ছিল, সেটাই সান্ত্বনা।
কয়েক বছর আগে সেই বড় ছেলেও যখন এক ভোরে মাত্র আধা ঘন্টার সময়ে চলে যায়, তখন রোজা চলছিল। রাবেয়া খাতুনের ততদিনে স্মৃতিভ্রম ঘটে গেছে। কিছুই মনে পড়ে না। কাউকে কাউকে চিনতেও পারেন না। প্রতিদিন সুযোগ পেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এ-পাড়া, ও-পাড়া ঘুরে আসেন। সবার ভালমন্দ খোঁজ নিয়ে ফেরেন তিনি, তাঁর আর ভাল থাকা হয় না। পথে পথে খুঁজে ফেরেন বড় ছেলেকে, একে-ওকে জিজ্ঞাসা করেন ছেলের কথা। সবাই বোঝে, মাথাটা আর ঠিক নেই রাবেয়া খাতুনের। তাই সবাই সান্ত্বনার কথা বলে যান। আর চোখে চোখে রাখেন। পাগলিনী রাবেয়াকে ঘরে ধরে রাখাই দায় হয়ে যায় সবার।
সেই রাবেয়ার আজ ছিল শেষদিন। জীবন থেকে ছুটি নেয়ার শেষমূহূর্তে ছেলেমেয়েরা সবাই কাছে ছিল। গত সাতদিন ধরেই তারা সবাই মায়ের কাছে। মাকে উত্তরমুখী করে শুইয়ে রাখা হয়েছে, কানে কানে ‘আম্মা আম্মা’ বলে ডাকছে ছেলেরা, মেয়েরা, রাবেয়া খাতুনের কোন সাড়া নেই। মাঝে মাঝে এক চোখ একটু খোলেন, আবার বন্ধ করেন।
বরাবর শান্ত স্বভাবের ছিলেন রাবেয়া। কোনদিন কেউ তার মুখ থেকে জোরে কোন কথা শুনেছে বলে মনে করতে পারে না। বেশ কদিন ধরেই চলছিল একজন মানুষের একটা জীবন অধ্যায়ের শেষ পর্ব। ডাক্তার আসছে, ডাক্তার যাচ্ছে, স্যালাইন আর চলছে না, মুখ দিয়েও কিছু খাওয়ানো যাচ্ছে না। প্রায় দশদিন পর তাঁকে নলের সাহায্যে খাওয়ানো হলো। মনে হলো, শরীর চাঞ্চল্য ফিরেছে একটু। জানতে চাইলে উত্তরও দিলেন। পরদিন সকালেই তিনি চিরদিনের মতোন চোখ বুঁজলেন, চলে গেলেন স্বামী আর বড় ছেলের কাছে আবারও সংসার করতে। কে জানে, সেই সংসারেও হয়তো তাঁর নুন-ডালের অভাব কোনদিন হবে না।
শান্তিবাগের শান্ত নারীটি, যে কিনা গত কয়েক বছর ধরে প্রতিবেশিদের খোঁজ নিয়ে ফিরছিলেন, আজ তাঁর চলে যাওয়াতে সেই জায়গাটি শূন্য বোধ কেউ করবে কিনা, কে জানে! খুব সাদামাটা জীবন হলেও তাঁকে কোনদিন উগ্রবাদী ধার্মিক হতে দেখা যায়নি, অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী হতেও কেউ দেখেনি। শিবানীর মা তো চিরটা কালই তাঁর পায়ের কাছে বসে থেকে গেল। বড় ছেলেটাও ছিল তাঁরই মতোন। সেই ছেলের মৃত্যুতে শান্তিবাগে হিন্দুপাড়ার মানুষের ঢল নেমেছিল। কার মেয়ের পরীক্ষার খরচ, কার বিয়ের খরচ, সব দিয়ে গেছে সেই ছেলে। অথচ তার নিজস্ব কোন আয় ছিল না। বন্ধুদের কাছ থেকে হাত পেতে চেয়ে নিত সে।
আজ রাবেয়া খাতুনের শেষযাত্রায় এটা নিশ্চিত যে, কলেজ রোডের এই বাড়িটি থেকে আজ একটি অধ্যায় সত্যিই শেষ হয়ে গেল। আজ থেকে সেখানে রচিত হবে নতুন্ কোনো রাবেয়া খাতুনের নতুন পর্ব। হোসেন ভিলাটি আজ সত্যিই অচেনা হয়ে গেল।